• মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৬ ১৪৩১

  • || ১২ জ্বিলকদ ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

দাদনের ফাঁদে বন্দি জীবন, মৃত্যুতেও মেলে না মুক্তি

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১০ মে ২০২৪  

ভোলার লালমোহন উপজেলার জেলেদের জীবন আটকে আছে দাদনের ফাঁদে। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় স্থানীয় মৎস্য আড়তদারদের থেকে জেলেরা দাদনের ওপর টাকা নেন। যুগের পর যুগ আড়তদারদের দাদনের টাকা জেলেদের ঘাড়ে চেপে থাকে। এই দাদনের ফাঁদ থেকে বের হওয়ার যেন কোনো সুযোগ নেই জেলেদের। মৃত্যুতেও মেলে না দাদন থেকে মুক্তি। জেলেপল্লীর সবারই আড়তদারের দাদনের ফাঁদে বন্দি।
লালমোহন উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের বাতিরখাল মৎস্যঘাটের জেলে আমান উল্যাহ ও আবু তাহেরের সঙ্গে কথা হয় দাদনের বিষয়ে। তারা জানান, যিনি টাকা প্রদান করেন বা যার কাছ থেকে দাদন নেয়া হয় তাকে আড়তদার বলে। যার নিজের নৌকা আছে তাকে মহাজন বলে। মহাজনের নৌকায় মহাজনসহ অনেকে মিলে মাছ ধরতে যায়। যখন একটি নৌকা নদীতে মাছ ধরতে যাবে তখন জাল, ইঞ্জিন, নৌকা মেরামতের জন্য আড়তদার থেকে দাদন নেন মহাজন। এই দাদনের শর্ত থাকে যত টাকার মাছ বিক্রি হবে সেখানকার ১০০ টাকার ১০ টাকা আড়তদারকে দিতে হবে এবং ঐ আড়তদারের মাধ্যমেই মাছ বিক্রি করতে হবে। মাছ বিক্রির শতকরা ১০ টাকা নিলেও দাদনের পুরো টাকাই ফেরত দিতে হবে।

ঐ মৎস্যঘাটের হেলাল ও আইয়ুব নামে আরো দুই জেলে বলেন, মহাজনরা আড়তদারদের কাছ থেকে দাদনের টাকা নিয়ে নৌকা বা ট্রলারে থাকা অন্যান্য জেলেদের মাঝে টাকা বিতরণ করেন। এরপর মহাজন নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় দাদনের টাকা নেয়া ১০ থেকে ১৫ জন জেলেকে সঙ্গে নেন। জেলেরা মাছ ধরা এবং বিক্রির উপর টাকা পায়। দেখা যায় মহাজন নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে আড়তদারের থেকে যে টাকা নেন, মাছ না পেলে ঐ টাকা দেনাই থেকে যায়। আবার নতুন করে মাছ ধরতে গেলে আড়তদারের কাছ থেকে আবারো দাদন নিয়ে যায়। এভাবে দাদনের টাকা বাড়তে বাড়তে এক সময় ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যায়।

জেলেরা যতদিন নদীতে মাছ ধরবে ততদিন আড়তদার দাদনের টাকা ফেরত চায় না। জেলেরা যখন মাছ ধরা ছেড়ে দেয় তখন বৈঠকের মাধ্যমে আড়তদারের টাকা ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ঐ টাকা ফেরত দিতে গিয়ে দেনাগ্রস্ত অনেক জেলেকে ভিটেমাটি বিক্রি করতে হয়। যার কারণে ইচ্ছা থাকার পরও অনেকে জেলে পেশা ছাড়তে পারছেন না। এভাবেই অধিকাংশ জেলেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হয় দাদনের বোঝা। মৃত্যুর পরও মেলে না মুক্তি। কারণ দাদন নিয়ে মারা গেলে তার ওয়ারিশরা দাদনের ঐ টাকা ফেরত দিতে হয় বলে জানান তারা।

ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের বাতিরখাল মৎস্যঘাটের সাদিয়া ফিশ এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার মমিন জানান, মৎস্য আড়তদারদের জেলেদের পেছনে অনেক টাকা পুঁজি খাটাতে হয়। নৌকা তৈরির শুরু থেকেই আড়তদারদের পুঁজি খাটানো শুরু হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে জাল, ইঞ্জিনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ের জন্য জেলেদের টাকা দিতে হয়। এছাড়া নদীতে মাছ শিকারে নামার সময়ও জেলেদের টাকা দিতে হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে তারা টাকা নেন। মাছ বিক্রির উপর ১০ পার্সেন্ট কমিশন পান আড়তদার। এভাবে একটি নৌকাতে আড়তদারের ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা দাদন হিসেবে দিতে হয়।

তিনি আরো জানান, নদীতে ভালো মাছ পেলে জেলেদের দাদনের টাকা পরিশোধ করতে বেশি সময় লাগে না। আর যদি মাছ না পায় তাহলে দেনার পরিমাণ বাড়তেই থাকে। গত কয়েক বছর নদীতে মাছ কম। এতে জেলেদের চেয়েও আড়তদাররা আরো বেশি সমস্যায় রয়েছে। এই বাতিরখাল মৎস্যঘাটের অনেক আড়তদার কোটি টাকারও বেশি জেলেদের দাদন হিসেবে দিয়েছেন।

লালমোহন উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২৪ হাজার ৮০৬ জন। তবে এর প্রকৃত সংখ্যা অন্তত ৩০ হাজার। যারা কেবল মাছ ধরার উপরই নির্ভরশীল। লালমোহন উপজেলার ছোট-বড় অন্তত ২৭টি মৎস্যঘাট থেকে জেলেরা মাছ ধরতে নদীতে নামেন। উপজেলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকাকে অভয়াশ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এ বিষয়ে লালমোহন উপজেলা সামুদ্রিক মৎস্য কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ বলেন, সাস্টেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় উপজেলার ১২টি মৎস্যজীবী গ্রাম সমিতি রয়েছে। যেখান থেকে জেলেদের মাঝে ঋণ প্রদান করা হয়ে থাকে। জেলেদের সন্তানদের পড়াশোনায় উৎসাহিত করার জন্য বৃত্তি ও বিনামূল্যে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন সময় জেলেদের মাঝে বৈধ জাল বিতরণ ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য বকনা বাছুর বিতরণ করা হচ্ছে। আমাদের আশা, এর মাধ্যমে জেলেরা কিছুটা হলেও দাদনের বোঝা থেকে রক্ষা পাবেন।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল