• শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ০৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

শেখ হাসিনার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের বার্তা: রাজনীতিতে তোলপাড়

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২০ আগস্ট ২০২৩  

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের দৈনিক আনন্দবাজার এক প্রতিবেদন ছেপেছে যে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কূটনৈতিক এক বার্তায় বাংলাদেশকে চাপে না রাখার অনুরোধ করেছে।

এই খবর ছাপা হওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় চলছে। বিএনপি বলছে, ভারত হস্তক্ষেপ করছে। আওয়ামী লীগ বলছে, ভারত নিজের স্বার্থে এমন বলছে। 

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে, যেখানে কেউ নির্দিষ্ট দলের পক্ষে কাজ করে না। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতসহ একাধিক রাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে বলেই তারা কথা বলে।

ভারতের দৈনিক আনন্দবাজার শুক্রবার ‘হাসিনাকে দুর্বল করলে ক্ষতি সবার, বার্তা আমেরিকাকে’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছে যে ভারত বাংলাদেশের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে যে ওয়াশিংটন যাতে ঢাকাকে বেশি চাপে না রাখে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঢাকায় সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হোক এটা ওয়াশিংটনের মতো ভারতও চায়। কিন্তু যেভাবে হাসিনা সরকারকে অস্থির করার জন্য আমেরিকার তরফ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে, তা প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক নয়। সাউথ ব্লক (ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) মনে করে, জামায়াতে ইসলামীকে ‘রাজনৈতিক ছাড়’ দেওয়া হলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা মৌলবাদের দখলে চলে যাবে। উদার পরিবেশ যেটুকু রয়েছে, তা-ও আর থাকবে না। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘতম স্থলসীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। ফলে সে দেশের যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি ভারতেও প্রভাব ফেলে। 

সূত্রের মতে, নয়া দিল্লি এ কথাই বাইডেন প্রশাসনকে জানিয়েছে যে, জামায়াতকে আশকারা দিলে এক দিকে যেমন ভারতের আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বাড়তে পারে, তেমনই চীনের প্রভাব বাংলাদেশে অনেকটাই বেড়ে যাবে, যা কাক্সিক্ষত নয় ওয়াশিংটনেরও। মনে করা হচ্ছে, আমেরিকা জামায়াতকে বরাবর রাজনৈতিকভাবে ইসলামিক সংগঠন হিসেবেই দেখানোর চেষ্টা করে। মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে তাকে তুলনা করে আমেরিকা। কিন্তু বাস্তবে জামায়াত যে উগ্র মৌলবাদী সংগঠন এবং পাকিস্তানের হাতে তামাক খায়, এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ নয়া দিল্লি।’

দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় এমন খবর ছাপা হওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় চলছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শনিবার এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তা হলে এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি ভারত কোনো পদক্ষেপ নেয়, সেটা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। অন্যদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আঞ্চলিক রাজনীতির বিষয়ে এই ভূখণ্ডে ভারত ও আমেরিকার অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। তাই ভারত আমেরিকাকে কিছু বললে তারা তাদের স্বার্থে বলেছে।

ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বর্তমান ক্ষমতাসীন দল যুক্তরাষ্ট্রের চাপে আছে, এটা ঠিক। আবার প্রতিবেশি দেশ ভারত সরকারের সঙ্গেও তাদের সখ্য এবং ভালো ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এর আগেও তেল ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দিলে বাংলাদেশ ভারতের পরামর্শ চেয়েছিল। এর আগে ভারত ইস্যুতে বেফাঁস মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বেকায়দায় পড়েছিলেন। দৈনিক আনন্দবাজার 
বাংলাদেশ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপার আগে কয়েক দিন আগেই ক্ষমতাসীন দলের একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফর করে। সেই সফরে তারা ভারতের ক্ষমতাসীন দলের সহযোগিতা চাইতেই পারেন। কেননা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থাৎ দুই দেশের সরকারের মধ্যে এখন খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চলছে। আবার সহযোগিতা চাইলেই যে পাওয়া যাবে, সেটা আবার ঠিক না। মূল বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ ঘিরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এই দুই দেশেরই অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। যার মূলে রয়েছে ভূ-রাজনীতি এবং চীনকে ঠেকানো। চীন ইস্যুতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র আবার একমত। ভারত যদি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ বিষয়ে অনুরোধ করে তবে নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতেই নয়া দিল্লি এমন করেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অনুরোধ রাখবে তখনই যদি এর মধ্যে তাদের নিজেদের স্বার্থ বজায় থাকে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মা শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত পাশে থাকতে চায়। সহিংসতা ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে ঢাকার সঙ্গে এক হয়ে কাজ করবে নয়া দিল্লি। এমন সময় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে এক হয়ে কাজ করার অঙ্গীকারের কথাও জানান ভারতীয় রাষ্ট্রদূত।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব এবং রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রকৃত অর্থে নয়া দিল্লি ওয়াশিংটনকে কী বলেছে, তা আমরা জানি না। তবে বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছে তা সত্য। ভারত ভালোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রকে কনভে করেছে যে বাংলাদেশ ইস্যু ওয়াশিংটন যেন নয়া দিল্লির ওপর ছেড়ে দেয় এবং ঢাকাকে যেন বিরক্ত না করে। মূলত বিশ্বের সব অঞ্চলেই বড় বড় রাষ্ট্রগুলো ছোট ক্ষমতার রাষ্ট্রগুলোর প্রতি এমন করে থাকে। আঞ্চলিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এমন হয়। এই অঞ্চলের রাজনীতিতে ভারত এখন এমন সুযোগ নিচ্ছে। আবার ভারতের কথা যুক্তরাষ্ট্র শুনবেও। কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের হাজার গুণ বেশি স্বার্থ রয়েছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নিয়ে যা বলছে মুখের কথা, তাদের স্বার্থ যেখানে বেশি থাকবে তারা সেদিকেই যাবে। এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা কম। সবাই সবার স্বার্থ বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের প্রতি ভারতের সমর্থনের পেছনে ছিল নয়া দিল্লির স্বার্থ বজায় রাখা।

সাবেক সচিব এবং যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার এ এইচ মোফাজ্জল করিম এই প্রতিবেদককে বলেন, আনন্দবাজার যা ছেপেছে তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে আমি বলব, এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। অর্থাৎ একটি দেশে কে ক্ষমতায় আসবে না আসবে, কে নির্বাচনে জয়যুক্ত হবে, কে হবে না, সেটা সেই দেশের জনগণ এবং ভোটারদের ওপর নির্ভর করে। এটাতে তৃতীয় পক্ষ কেউ বাইরে থেকে সুপারিশ করবে এবং চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে, এটা ঠিক নয়। এমন হয়ে থাকলে আমি মনে করি, এটা অনৈতিক এবং এমনটা ঠিক হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ সাহান এই প্রতিবেদককে বলেন, আনন্দবাজারের প্রতিবেদনের পর বিএনপি বলেছে যে হস্তক্ষেপ আর আওয়ামী লীগ বলেছে এটা তাদের (ভারত) স্বার্থ। মজার বিষয় হচ্ছে বিষয়টা উল্টো হলে বিএনপি বলত এটা তাদের স্বার্থ আর আওয়ামী লীগ বলত হস্তক্ষেপ। এটা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য। কিন্তু এই ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কেউই নির্দিষ্ট কোনো দলের পক্ষে কিছু বলে না। ভারত যেটা বলছে তাতে তার পেছনে তাদের স্বার্থ রয়েছে। এই এলাকায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ভারতের নিজের স্বার্থে যতটা প্রয়োজন ততটাই প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে। মূলত এখানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে যে প্রভাব পড়বে তার ওপরই জোর দেওয়া হচ্ছে। আমরা যতটুকু দেখছি, সেখানে ভারত বলছে, যুক্তরাষ্ট্র যা করছে তাতে এই সরকার (আওয়ামী লীগ) ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভারতের এই প্রক্রিয়াকে আপনি যদি হস্তক্ষেপ বলেন তবে যুক্তরাষ্ট্র যা করছে সেটাও হস্তক্ষেপ। একটাকে হস্তক্ষেপ বলবেন, আরেকটাকে বলবেন না-এটা হতে পারে না। আবার একটাকে হস্তক্ষেপ হিসেবে চিন্তা না করলে আরেকটাকেও হস্তক্ষেপ হিসেবে চিন্তা করার অবকাশ কমে যাচ্ছে। আমার মনে হয় যে এখানে হস্তক্ষেপ চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃত অর্থে প্রত্যেকটা দেশ তাদের নিজস্ব স্বার্থ থেকে কাজ করার চেষ্টা করে থাকে। এটাই আন্তর্জাতিক রাজনীতি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন বেপারী এই প্রতিবেদককে বলেন, আনন্দবাজার যা ছেপেছে তাতে বিষয়টা এমন যে চিল কান নিয়ে গেছে, আর আমরা কানে হাত না দিয়ে চিলের পেছনে দৌড়াচ্ছি। আগে দেখতে হবে যে আনন্দবাজার যে খবর ছেপেছে তা সত্য নাকি মিথ্যা। আনন্দবাজারের ছাপা খবরে সোর্স উল্লেখ করা হয়নি, এই খবরের বস্তুনিষ্ঠতা সঠিক নয়। আনন্দবাজার আগেও বহু খবর ছেপেছে, যেগুলোর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে। আবার আনন্দবাজার যাই ছাপুক না কেন ভারত চাইবে সারা জীবনের জন্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক। কারণ ভারতের স্বার্থ একমাত্র আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই রক্ষা হয়। কয়েক দিন আগে ভারতের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেছেন, নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমার কাছে ভারতের মুখপাত্র যা বলেছে তা অথেনটিক কিন্তু আনন্দবাজারের খবর অথেনটিক না। এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত জুনে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার আগেও এমন একটি ধুয়া উঠেছিল যে ভারত বাংলাদেশের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ করবে যাতে ওয়াশিংটন ঢাকাকে বেশি চাপে না রাখে। ওই সময়ে আমরা দেখেছি যে নরেন্দ্র মোদির সফরে প্রকৃত অর্থে এমন কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা আরও দেখলাম যে নরেন্দ্র মোদির সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আরও চেপে ধরল, ভিসানীতি প্রকাশ করল। এরপর যারা ভারত বন্দনা করছিল তারা চুপসে গেল। আবার আনন্দবাজারের খবর যদি সঠিক হয় তবে যুক্তরাষ্ট্রে তো বাইডেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না, সেখানে সিদ্ধান্ত নেয় ইনস্টিটিউট এবং একাধিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। সেখানে আরও দুই বছর আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও অনেক আগেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা বাংলাদেশকে তাদের নিজেদের আলোয় দেখবে, বাংলাদেশকে আর প্রতিবেশীর (ভারত) আলোয় দেখবে না।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল