• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

২শ’ বছরের খ্যাতি ধরে রেখেছে টাঙ্গাইলের চমচম

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

প্রতিযোগিতার বাজারেও ২শ’ বছরের খ্যাতি ধরে রেখেছে টাঙ্গাইলের চমচম। বিদেশে রপ্তানি না হলেও অতুলনীয় স্বাদের কারণে এ জেলা থেকে গড়ে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে ৩-৫ হাজার কেজি চমচম। চমচমের খ্যাতি ধরে রাখতে এ ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছেন জেলার প্রায় পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ী। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন টাঙ্গাইল জেলা রেস্তরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ। ১৬০৮ সালে পোড়াবাড়ী গ্রামটিকে নদীবন্দর হিসেবে গড়ে তোলা হয়।

সে সময় ধলেশ্বরীর পশ্চিম তীরে গড়ে উঠেছিল জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে এই পোড়াবাড়ী বাজার। তখন পোড়াবাড়ী ঘাটে ভিড় তো বড় বড় সওদাগরি নৌকা, লঞ্চ আর স্টিমার। সে সময়েই ওই বাজারে যোগ হয় সুস্বাদু এই চমচম। এর সুবাধে পোড়াবাড়ীতেই গড়ে ওঠে মিষ্টির বাজার। ধীরে ধীরে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে শুধু পোড়াবাড়ীতেই।


পোড়াবাড়ীর মিষ্টি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বর্তমানে খোকা ঘোষ ও গোপাল চন্দ্র দাসের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে এখন পোড়াবাড়ী নয়, মিষ্টি শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছে টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনি বাজার। বিজ্ঞাপন জয়কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, আনন্দময়ী, ভাগ্যলক্ষ্মী ও টাঙ্গাইল পোড়াবাড়ী মিষ্টি ঘরে এখনো নির্ভেজাল পোড়াবাড়ীর চমচম পাওয়া যায়। এই পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। আর যেখানে চমচমের জন্ম সেই পোড়াবাড়ীতে এখন রয়েছে হাতেগোনা মাত্র চার থেকে পাঁচটি মিষ্টির দোকান। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। তাইতো পোড়াবাড়ীর চমচমকে বলা হয় ‘মিষ্টির রাজা’।

পোড়াবাড়ীর এই চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রায় ২শ’ বছরের পুরোনো ইতিহাস। ইতিহাস বলছে- দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি বৃটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়ীতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। সেই থেকেই এখানে শুরু হয় মিষ্টির ব্যবসা। বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন।


টাঙ্গাইলের মোদক উপাধি প্রাপ্তরাও মিষ্টি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। আর জেলার পরিচিতি নির্ধারক চমচমের পাশাপাশি এখন সাদা চমচম, রসগোল্লা, আমির্তী, পানতোয়া, ক্ষিরমোহন, রসমালাই, মালাইকারী, বেবি সুইটস, ছানার পোলাও, দই (লাল), দই (সাদা), ঘি, ঘি (সর), মাওয়া, টক দই, সন্দেশ, জিলাপি, প্যারা, কালোজাম, দানাদার, খাজা, বাতাসা, কদমা, নই টানা ইত্যাদি মিষ্টিও মন ভিজিয়েছে খাদ্য রসিকদের।

কিন্তু টাঙ্গাইলের মিষ্টি মানেই পোড়াবাড়ীর চমচম। চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা।

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতি নির্ধারিত প্যাকেট ছাড়া প্রতি কেজির মূল্য চমচম-৩০০, চমচম (সাদা) ৩৫০, রসগোল্লা ৩০০, আমির্তী ৩০০, পানতোয়া ৩০০, ক্ষিরমোহন ৩০০, রসমালাই ৪০০, মালাইকারী ৪৫০, বেবি সুইটস ৩০০, ছানার পোলাও ৫০০, দই (লাল) ২৫০, দই (সাদা) ৩০০, ঘি ১৩০০, ঘি (সর) ১৫০০, মাওয়া ১২০০, টক দই ১০০, সন্দেশ ৭০০, জিলাপি ১২০, প্যারা ৭০০, কালোজাম ৩০০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, চমচম একটি উপাদেয় মিষ্টান্ন, যা যে কোনো বয়সের লোকের কাছে লোভনীয়। বিয়ের অনুষ্ঠান, পূজা, জন্মদিনে, পরীক্ষার ফলাফল, চাকরির প্রমোশন, নির্বাচনে জয়ী, নতুন চাকরি, শ্বশুরবাড়ি বা আত্মীয় বাড়ি যাওয়ার সময় এই চমচম দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় এখনো সর্বমহলে প্রচলিত রয়েছে।

শহরের পাঁচআনি বাজারের প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকানে প্রতিদিন তৈরি হয় পোড়াবাড়ীর চমচম। বেশির ভাগ দোকানের মালিক নিজেরাই এ চমচম তৈরি করেন। আবার তাদের সহায়তায় রয়েছে একাধিক কারিগর ও সহযোগী। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হচ্ছে। চমচম এখনো কেন এত জনপ্রিয়, এমন প্রশ্নে আরিফ, বাবলুসহ একাধিক ক্রেতা বলেন, ‘ছোট বেলায় দেখেছি হাতেগোনা কয়েক’টি দোকান ছিল। এখন অনেকগুলো দোকান হয়েছে। শৈশবে মিষ্টির স্বাদ ও বর্তমানের মিষ্টির স্বাদ কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তবে মিষ্টির গুণগত মান আগের তুলনায় খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। অন্য মিষ্টির তুলনায় পোড়াবাড়ীর চমচম অনেক সুস্বাদু।

দীর্ঘ পরিক্রমায় এখনো সেই সুনাম ধরে রেখেছেন চমচম ব্যবসায়ীরা।’ জয়কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কর্ণধার সুমির ঘোষ বলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষ থেকে মিষ্টি ব্যবসায় নিয়োজিত। এটা আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য। এজন্য আমিও মিষ্টির ব্যবসা করছি। সারা দেশে আমাদের মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে ৩শ’ টাকায়। মান ও গুণগতভাবে আমাদের মিষ্টি অন্য দোকানের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। এজন্য বিক্রিও হচ্ছে বেশি।’ গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কর্ণধার দ্বীপ দাস বলেন, ‘মান ও গুণগতভাবে আমাদের মিষ্টির সুনাম রয়েছে।

চমচম টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য বহন করে। তাই আমরাও সেই ঐতিহ্য রক্ষায় মিষ্টির মান অনেক ভালো করি। মিষ্টির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে চিনির দাম বেড়ে গেছে। আর প্যাকেট ছাড়া মিষ্টির ওজন দিতে হচ্ছে। এজন্য মিষ্টির দাম কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। এখন প্রতি কেজি মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে তিনশ’ টাকায়। প্রতি কেজিতে থাকছে ১৪ থেকে ১৬ পিস করে মিষ্টি।’

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল জেলা রেস্তরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ জানান, ‘আমার বাবা ১৯৩৯ সাল থেকে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। সেখান থেকে আমিও মিষ্টির ব্যবসা করছি। আমার পরের প্রজন্ম আমার ছেলেও এ ব্যবসায় সম্পৃক্ত রয়েছে। মূলত এই পোড়াবাড়ীর চমচমের উৎপত্তি হয়েছে সেই বৃটিশ আমল থেকে।’ চমচমের স্বাদ প্রসঙ্গে স্বপন ঘোষ বলেন, চমচম সুস্বাদু হওয়ার অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে- চরাঞ্চল থেকে যে সমস্ত গাভীর দুধ আসে, সেগুলো অনেক ভালো। আর জলেরও একটা বিষয় আছে। দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয়। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার হয় না। এসব কারণেই চমচম বিখ্যাত হয়েছে।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ীর মিষ্টির সুনাম রয়েছে। তবে তৎকালীন সময়ে মিষ্টির যে ফ্লেভার ছিল, সেটা বর্তমানে নেই। আমরা চেষ্টা করছি আগের ফ্লেভার ধরে রাখতে। তারপরও টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর মিষ্টির চেয়ে কোথাও আর ভালো মিষ্টি তৈরি হয় না।’

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল