• বৃহস্পতিবার ০৩ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ১৮ ১৪৩১

  • || ২৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ছেলেকে খাবার দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন দিন মজুর কামাল

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪  

মাদ্রাসায় পড়ুয়া একমাত্র ছেলেকে খাবার ও জামা কাপড় পৌঁছে দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন দিন মজুর কামাল মিয়া।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই শুক্রবার রাজধানীর মালিবাগ এলাকায় নির্মম এই ঘটনা ঘটে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির করুন মৃত্যুতে তার সুখের সংসারে অন্ধকার নেমে এসেছে। বাসা ভাড়া, পরিবারের সদস্যদের খাবার জোগানো নিয়ে শহিদ কামাল মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন এখন দিশেহারা। বাঁচার তাগিদে তিনি এখন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। পাশাপাশি চেষ্টা করছেন একটি স্থায়ী কাজ যোগাড় করতে যাতে পরিবার নিয়ে কোনমতে বেঁচে থাকতে পারেন।
ফাতেমা খাতুন জানান, ঘটনা গত ১৯ জুলাই শুক্রবার। কয়েকদিন ধরে টানা আন্দোলন ঢাকায়। বিভিন্ন স্থান থেকে শুধু গুলিতে নিহত হওয়ার খবর শুনছিলাম। ওইদিন আমার স্বামী সারাদিন বাসায় ছিলেন। মাগরিবের নামাজের পর ছেলে ইয়াছিনের জন্য কিছু খাবার ও কাপড় নিয়ে মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ইয়াছিন মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার শেখ জনরুদ্দিন দারুল উলুম মাদ্রাসায় নাজেরা বিভাগে লেখাপড়া করছে। বটতলার বাসা থেকে বের হওয়ার কিছু সময়ের ভেতরে একটি ছেলে এসে আমাদের জানায় আমার স্বামী কামাল মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাকে লোকজন সিএনজি করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেছে। ফাতেমা খাতুন বলেন, আমি আমার এক মেয়েকে নিয়ে শান্তিনগর-কাকরাইল রাস্তায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আক্রমণাত্মক পরিস্থিতি অতিক্রম করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যাই। হাসপাতালে গিয়ে আমার স্বামীকে বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করি। পরে মর্গে গিয়ে স্বামীকে খুঁজে পাই। দেখতে পাই মর্গে আমার স্বামীর গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ পড়ে আছে। তার শরীরে হাত দিয়ে দেখি গুলি তার পিঠে লেগে পেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। গুলিবিদ্ধ স্থান থেকে তখনো রক্ত ঝরছিল। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ফাতেমা বলেন, পরদিন ২০ জুলাই শনিবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডেথ সার্টিফিকেটসহ স্বামীর লাশ বুঝিয়ে দেয়া হয়। লাশ বুঝে পেয়ে বৈরি পরিস্থিতিতে জানাজা শেষে দাফন করা হয়।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) -তে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে পিয়ন পদে চাকরি করতেন কামাল মিয়া। ওই কাজের ফাঁকে রিকশা চালিয়েও উপার্জন করে ছয় সদস্যের পরিবারের যাবতীয় খরচ মেটাতেন তিনি।
ফাতেমা খাতুন বলেন, ১৫৩/১১ শান্তিনগর বটতলার ছোট একটি বাসায় স্বামী-সন্তান নিয়ে তাদের বসবাস ছিল। এখনো সেখানেই রয়েছেন। স্বামীর রোজগারেই ছয় সদস্যের পরিবার চলতো।পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে চার সন্তানের আহার, বাড়ি ভাড়া ও লেখাপড়ার খরচের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি। চার সন্তানের মধ্যে এক ছেলে ও তিন মেয়ে। এরমধ্যে তিন সন্তানই লেখাপড়া করেন। টাকার অভাবে তাদের লেখাপড়া এখন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
অসহায় ফাতেমা খাতুন বলেন, চলতি মাসের ভাড়া এখনো দিতে পারেননি। খাবারের বন্দোবস্ত করবো নাকি বাসা ভাড়া দিবো। এখন পর্যন্ত কেউ ওভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেনি। প্রায় দুই মাসের মতো হয়ে গেল, কোনো কাজ জোগাড় করতে পারিনি। এরই মধ্যে স্বামী যেখানে কাজ করতেন বিআইডব্লিউটিএ’তে মতিঝিলের অফিসে গিয়ে কথা বলেছি। সেখান থেকে বলা হয়েছে চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করার জন্য।
তার নিরপরাধ স্বামীর নির্মম মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচার দেখতে চান ফাতেমা খাতুন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবী জানিয়ে আন্দোলন করে আসছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন নির্মূলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে কঠোর অবস্থানে থেকে শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন। ওইদিন দেশব্যাপী ছয় জনের মৃত্যু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সারা বাংলাদেশের ছাত্র জনতা ফুসে ওঠে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন এক দফায় রূপ নেয়। আন্দোলনকে দমন ও নির্মূল করতে গিয়ে তৎকালীন আওয়ামী সমর্থিত ক্যাডার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার সহস্রাধিক মানুষ নির্মমভাবে গুলিতে নিহত হন। কয়েক হাজার মানুষ গুলিতে মারাত্মক আহত হয়ে এখনো দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, গণতন্ত্রকামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ও সাধারণ মানুষের লাল বিপ্লবে গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বিগত সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অপশাসন, হত্যা, গনহত্যা, ও গুমের সাথে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন নতুন সরকার। পাশাপাশি আন্দোলনে শহিদ ও ক্ষতির শিকার পরিবারের পাশে দাঁড়াতে কার্যক্রম চলছে।