• বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৫ ১৪৩১

  • || ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

দেড় ডজন ধান সম্প্রসারণে তৎপর কৃষি মন্ত্রণালয়

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২০ মে ২০২৩  

এ বছর দেশের মোট বোরো আবাদ হয় প্রায় ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে উফসী জাতের ধান আবাদ হয় প্রায় ৩৫ লাখ ৭৮ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে। ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ আবাদ হয়েছে প্রায় ১৮ লাখ হেক্টর জমিতে (প্রায় ৫০ ভাগ)। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এ দু’টি ধানের জাত গত কয়েক বছর হলো ব্লাস্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ায় কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ অবস্থায় কৃষিবিদসহ কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা এ দু’টি ধান চাষে কৃষককে নিরুৎসাহিত করে আসছেন। যদিও এখন পর্যন্ত এ দু’টি জাতের বিকল্প কোনো জাত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তবে ব্রি ও বিনার প্রায় দেড় ডজন ধানের জাত ব্রি ২৮ ও ২৯-এর বিকল্প হিসেবে চাষে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে পরামর্শ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষিবিদসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হঠাৎ করেই ব্রি ২৮ ও ২৯ ধানের জাত বাদ দেয়া যাবে না। রাতারাতি এ দু’টি জাতের বীজ উৎপাদন বন্ধ করা যাবে না। বিএডিসির মাধ্যমে ব্রি ধান ২৮ ও ২৯-এর বীজ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অর্ধেক এবং এরপরের বছর তা শূন্যের কোঠায় আনার সুপারিশ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইং। আসন্ন সিড প্রমোশন কমিটির সভায় এ সংক্রান্ত সুপারিশ উত্থাপন শেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত ১৬ মে সচিবালয়ে বোরো ধানের বীজ সরবরাহ লক্ষ্যমাত্রা বিষয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইংয়ের মহাপরিচালক (যুগ্মসচিব) মো: আবু জুবাইর হোসেন বাবলু। সভার কার্যবিবরণী সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সভাপতির বক্তব্যে মো: আবু জুবাইর হোসেন বাবলু বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যঘাটতি মেটাতে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ধানের আবাদ বৃদ্ধিতে পুরনো জাতের চাষাবাদ হ্রাস করে নতুন অধিক ফলনশীল সম্ভাবনাময় ধানের আবাদ বৃদ্ধি করতে হবে। ব্রি ধান ২৮ ও ব্রি ধান ২৯ আমাদের দেশের ১৯৯৪ সালে অবমুক্ত হওয়ার পর সুদীর্ঘ ২৯ বছর বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে আসছে। সম্প্রতি ব্রি ধান ২৮ ও ব্রি ধান ২৯-এ ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আরো অধিক ফলনশীল সম্ভাবনাময় ধানের জাত ছাড়করণ হয়েছে। যার ফলন ব্রি ধান ২৮ ও ব্রি ধান ২৯ এর তুলনায় অনেক বেশি। তাই জাত দু’টির বিকল্প আমাদের চিন্তা করতে হবে।


আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএডিসির সদস্য পরিচালক (বীজ ও উদ্যান উইং) মো: মোস্তাফিজুর রহমান ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ জাতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, এই মুহূর্তে বিএডিসি চুক্তিবদ্ধ চাষিদের কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কম সংগ্রহ করলে চাষিরা নিরুৎসাহিত হবে। একইভাবে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তাদের সাথে চুক্তিরও বরখেলাপ হবে। এ বছর বিএডিসির খামার ও চুক্তিবদ্ধ চাষিদের মাঠে নাটিভো স্প্রে করায় কোনো প্রকার ব্লাস্ট রোগ দেখা যায়নি বলে দাবি করেন তিনি।

সভায় বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এ এইচ এম হুমায়ন কবির বলেন, হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আছে তবে ইনব্রিড ধানের ক্ষেত্রে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো সেভাবে বাংলাদেশে চাষিদের বীজ সরবরাহ করতে পারবে না। বিএডিসিকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। রাতারাতি ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ জাতের বীজ উৎপাদন বন্ধ করা যাবে না। চাষিগণকে উদ্বুদ্ধ করে ধীরে ধীরে ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ প্রতিস্থাপন করে অন্য জাত দিতে হবে। ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ জাতের সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে। সারা দেশে ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ ধান ছাড়াও ব্রি ধান ৮৯-এ ব্লাস্ট রোগ দেখা গেছে। ব্রি ধান ৮৯ জাত হিসেবে নতুন এবং ব্লাস্ট অনাকাক্সিক্ষত।
বাংলাদেশ ধান গবেষষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও খামার ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান মো: সিরাজুল ইসলাম সভায় জানান, ব্রি উৎপাদিত ধানের জাতগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী কোনো জাত নেই। অনুকূল পরিবেশে সব জাতেই অল্প বিস্তর ব্লাস্ট রোগ দেখা যায়। অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করলে সতর্কতা হিসেবে ছত্রাকনাশক সাত দিন পর পর দুইবার স্প্রে করলে ধানে ব্লাস্ট কম আক্রান্ত হবে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সভায় জানান, ব্রি ধান ২৮-এর রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে বিনা ধান ১০ ও বিনা ধান ২৫-এর আবাদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। চাষি পর্যায়েও এর ব্যাপক চাহিদা। ব্রি ধান ২৫ প্রিমিয়াম কোয়ালিটির ধান উৎপাদন করে বিধায় চাষি পর্যায়ে চাহিদা তৈরি হচ্ছে।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো: তাজুল ইসলাম পাটোয়ারি সভায় জানান ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৫.৭৮৯ লাখ হেক্টর জমিতে উফশী বোরো ধানের আবাদ হয় যার মধ্যে প্রায় ১৮ লাখ হেক্টর জমিতেই ব্রি ধান ২৮ ও ২৯-এর চাষাবাদ হয়, যা সব আবাদকৃত জাতের শতকরা ৫০ ভাগ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ এর ৩৭ হাজার ২৩৪ মেট্রিক টন ধানবীজ বিএডিসি সরবরাহ করে যা মোট সরবরাহকৃত উফশী বোরো ধানের শতকরা ৫৮ ভাগ। কৃষকদের মধ্যে দীর্ঘদিনের জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ এর বিকল্প জাতগুলো ধীরে ধীরে চাষি পর্যায়ে জনপ্রিয় করে আবাদ বৃদ্ধি করতে হবে। ব্রি ধান ২৮ এর রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে বিনা ধান ২৫ মাঠ পর্যায়ে জনপ্রিয়তা থাকায় এ বছর বিএডিসির ৬০ মেট্রিক টন, বিনার ১০০ মেট্রিক টন, ডিএইর চাষি পর্যায়ে ৫ মেট্রিক টনসহ মোট ১৭৫ মেট্রিক টন বীজ ২০২৩-২৪ উৎপাদন বর্ষে বীজ উৎপাদন করে চাষি পর্যায়ে বীজ বিতরণ করা যেতে পারে এবং অন্যান্য বিকল্প জাতগুলো উৎপাদন বাড়াতে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে সে মোতাবেক কার্যক্রম নির্ধারণ করা যেতে পারে।


সভায় বিস্তারিত আলোচনার শেষে চলতি ২০২২-২৩ বোরো ধান বীজ সংগ্রহ মৌসুমে ব্রি ধান ২৮-এর ৮ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার শতকরা ৫০ ভাগ কমানো এবং পরবর্তী বছরে ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ এর বীজ সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে শূন্য করা যেতে পারে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া বিনা ধান ২৫ জাতটি সম্ভাবনাময় হওয়ায় বিএডিসি ৭০ মেট্রিক টন, বিনা ১০০ মেট্রিক টন ও ডিএইর চাষি পর্যায়ে ৫ মেট্রিক টনসহ মোট ১৭৫ মেট্রিক টন বীজ চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমে সংগ্রহ করে পরবর্তী মৌসুমে বীজ বর্ধন করে বিএডিসি কর্তৃক ১ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন বীজ চাষি পর্যায়ে বিতরণ করা যেতে পারে। বিষয়টি আসন্ন সিড প্রমোশন কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মত দেয়া হয়। সভায় ব্রি ধান ২৮ বিকল্প হিসেবে ব্রি ধান ৬৮, ৮১, ৮৬, ৮৮, ৯৬, ১০১, ১০৪, ১০৫, বঙ্গবন্ধু ধান ১০০, ব্রি হাইব্রিড ধান ৩, ৫ ও ৮ আবাদ করার বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়। ব্রি ধান ২৯-এর বিকল্প হিসেবে ব্রি ধান ৮, ৯২, ৯৭, ৯, ১০২ ধান আবাদের বিষয়েও একমত হন সবাই। তা ছাড়া লবণাক্ত এলাকায় বিনা ধান ১০ এবং অলবণাক্ত এলাকার জন্য বিনা ধান ২৫ জাতের আবাদ বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মত দেন সবাই। অন্যদিকে, চলতি বোরো মৌসুমে মাঠ পর্যায়ে বোরো ধানের কোনো কোনো জাতে এবং কোনো কোনো এলাকায় ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে জমির পরিমাণসহ তার একটি তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ জাতের পরিবর্তে বিকল্প বোরো ধানের জাত আবাদে চাষিদের মাঝে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দুই বছরের একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের নিমিত্ত বিএআরসি, ডিএই, বিএডিসি, ব্রি, বিনা, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি কোম্পানির প্রতিনিধি সমন্বয়ে কমিটি গঠন করার জন্য সিড প্রমোশন কমিটি কর্তৃক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে বলে সবাই মত দেন।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল