• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

পুরান ঢাকার বাকরখানি: ইতিহাসের করুণ প্রেম কাহিনির চিহ্ন

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ৫ মার্চ ২০২৩  

‘আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি/ বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি।’ প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের এই গান শুনলে বাকরখানির কদরটা যে বেশ তা সহজেই বোঝা যায়। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী যত খাবার আছে তার মধ্যে বাকরখানি অন্যতম। নরম মুচমুচে স্বাদের রুটি জাতীয় খাবার বাকরখানি। এ খাবারটি পুরান ঢাকার সকাল ও বিকেলের নাস্তার খাবার হিসেবে বেশি পরিচিত। তবে অনেকেই জানেন না, ভিন্নস্বাদের এ খাবারটির নাম কেন বাকরখানি। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, রাজকীয় পরিবারের এক করুণ প্রেম কাহিনির চিহ্ন এ খাবারটি।
বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খানের পালক পুত্র ছিলেন আগা মুহাম্মদ বাকের খান। বাকের খান মুর্শিদকুলি খানের স্নেহে চট্টগ্রামে প্রভাবশালী সেনা কমান্ডারে পরিণত হন। তার প্রেয়সী ছিলেন আরামবাগের নর্তকী খনি বেগম। কিন্তু মুর্শিদকুলির উজির আলা জাহান্দার খাঁর পুত্র কোতোয়াল জয়নুল খানের খনি বেগমের প্রতি লালসা ছিল।

একদিন খনির শ্লীলতাহানির চেষ্টা করায় জয়নুলকে গুম করে হত্যা করা হয়েছে বলে বাকের খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগে বাকেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বাঘের খাঁচায় বন্দি করে রাখেন মুর্শিদকুলি খান। কিন্তু বাঘ মেরে বীরত্ব দেখিয়ে খাঁচা থেকে মুক্ত হন বাকের। তবে বাকের বন্দি থাকার সুযোগে খনি বেগমকে জোর করে তুলে নিয়ে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের (বরিশাল) জঙ্গলে অত্যাচার করতে থাকেন জয়নুল। খবর পেয়ে বাকের রওনা হন সেখানে। যুদ্ধে আহত জয়নুল পরাজয় বুঝতে পেরে নিজের তরবারি খনির বুকে বসিয়ে দেন। বাকের খান এসে দেখেন প্রিয়তমা খনি মৃত্যু পথযাত্রী। প্রেয়সীর জন্য রন্ধনবিলাসী বাকের একটি নরম রুটি তৈরি করে খাওয়ান। নাম দেন ‘বাকের-খনি’। সেই থেকে প্রিয়তমার স্মৃতি রক্ষার্থে খাবারটির প্রচলন শুরু হতে থাকে। তবে মানুষের মুখে মুখে ‘বাকের খনি’ রূপ নেয় বাকরখানিতে।

যতদিন বাকরখানি থাকবে, ততদিন তাদের এই প্রণয়কাহিনি অমর হয়ে থাকবে বলে লেখক নাজির হোসেনের বিখ্যাত ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ বইয়ে এ ঘটনার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

কারো কারো দাবি, বাকরখানির উৎপত্তি আফগানিস্তানে। তবে বাংলার ইতিহাসে ও গীতিকবিদের মুখে মুখে রয়ে গেছে এ প্রেমকাহিনী। রাজকীয় এ খাবার পুরান ঢাকার খাদ্যাভাসে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সকালে মিষ্টি, নোনতা, ঝালসহ নানা স্বাদের বাকরখানি ও চা যেন এক রুটিন খাবার। এ এলাকার মানুষজনসহ বিখ্যাত বাকরখানির দোকানগুলোতে ভোজনরসিকরা দূর থেকে এসে নবাবী স্বাদ নিচ্ছেন।

প্রায় ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে নানা স্বাদের বাকরখানি বিক্রি করে আসছেন নাজিমউদ্দিন রোডের ‘নাসু ফারুকের সেরা বাকরখানি’। পনির, ঘি, খাস্তা, মিষ্টি, নোনতা ঘি, মিষ্টি ঘি আর ঝাল বাকরখানি- এই সাত রকম বাকরখানি বিক্রি হয় এ দোকানে। ৫ টাকা থেকে শুরু করে নানা দামের বাকরখানি রয়েছে।

এছাড়া নারিন্দার বিসমিল্লাহ বাকরখানি, বাদশা বাকরখানি, আলাউদ্দিনের বাকরখানি, লক্ষ্মীবাজারের হালিমের বাকরখানি, বংশালে শাহি বাকরখানি, নবাবপুরের হাশেমের বাকরখানি, শাঁখারিবাজারে দিব্য বাকরখানি, চকবাজারের আল্লাহর দান বাকরখানির দোকানগুলোতে অনেক আগে থেকে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে। শুধু এগুলো নয়- সারা পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে পাওয়া যাবে নতুন-পুরাতন বাকরখানির দোকান।

নারিন্দার বিসমিল্লাহ বাকরখানির কর্মচারীরা জানান, প্রতিদিন ৩০-৩৫ কেজি বাকরখানি বানান তারা। সকালে ও বিকেলে বেশি বিক্রি হয়। স্থানীয়রা এ খাবারটির বেশি ক্রেতা। কেজির পাশাপাশি খুচরা পিচ হিসেবেও বিক্রি হয়। প্রতি পিচ ৫ টাকা থেকে শুরু করে ১৫ টাকা পর্যন্ত আছে।

এছাড়া অন্য দোকানগুলোতে পনির, ঘি. কালোজিরা, চিনির বাকরখানিসহ মাংসের বাকরখানিও পাওয়া যায়। চকবাজারের দোকানগুলোতে মাংসের বাকরখানি মেলে। গরু, ছাগল ও মুরগির হাড় ছাড়িয়ে শুধু মাংস দিয়ে এ বাকরখানি বানানো হয়। খামি করার সময় এ মাংস বিশেষভাবে রান্না করে দেওয়া হয়।

বাকরখানি সম্পর্কে হাজি হাবিবুর রহমান মোল্লা নামে পুরান ঢাকার চকবাজারের এক বাসিন্দা বলেন, বাকরখানি আমরা বিকেলের নাস্তা হিসেবে খেয়ে থাকি। আমার বাবা-দাদাদের নাস্তার তালিকায়ও এ বাকরখানি থাকত। আমি খাচ্ছি, আমার ছেলেরা খাচ্ছে। এভাবে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। প্রায় ৩০০ বছরের বেশি পুরনো এ খাবার আমাদের নিজস্ব খাবার।

ভোজনরসিকরা ঐতিহ্যবাহী খাবার এই বাকরখানি খেতে বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে প্রতিদিনই ভিড় জমান পুরান ঢাকায়। এছাড়া এদেশে ঘুরতে এসে বিদেশিরাও স্মারক খাবার হিসেবে বাকরখানি নিয়ে যান বলে বিক্রেতারা জানিয়েছেন।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল