• সোমবার ০৬ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২২ ১৪৩১

  • || ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

গবেষণা চুরি প্রমাণ হলে তিন স্তরে সাজা

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২৪ অক্টোবর ২০২৩  

চৌর্যবৃত্তি রোধের মাধ্যমে একাডেমিক গবেষণা ও প্রকাশনায় স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা নিশ্চিত করতে নতুন একটি নীতিমালা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এতে অন্যের প্রকাশনা থেকে নেওয়া তথ্যকে নিজের বলে চালিয়ে দেওয়ার দায়ে জরিমানা, ডিগ্রি বাতিল ও পদাবনতি, এমনকি চাকরিচ্যুতির মতো গুরুতর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। তবে গবেষণা কর্মের ২০ ভাগ পর্যন্ত তথ্য ভিন্ন উৎস থেকে নেওয়া হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। এর বেশি নকল বা চুরি প্রমাণ হলে নতুন নীতিমালায় তিন স্তরে সাজার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কারও ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার সর্বোচ্চ অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে শুধু তাকে চাকরিচ্যুত করা যাবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ নতুন নয়। সর্বশেষ চলতি বছরের মে মাসে পিএইচডি গবেষণায় জালিয়াতির অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট। গত কয়েক বছরে গবেষণায় তথ্য চুরির অভিযোগ যেমন এসেছে, তেমনি এ অভিযোগে শাস্তির ঘটনাও ঘটেছে। এ কারণে দেরিতে হলেও গবেষণায় তথ্য চুরি ঠেকাতে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত ৩০ মে নতুন এই নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং বর্তমান উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল কালবেলাকে বলেন, ‘কাউকে শাস্তি দেওয়া এ নীতিমালার মূল লক্ষ্য নয়। একজন গবেষকের গবেষণায় যে নৈতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা প্রয়োজন, সেই মানদণ্ড অনুসরণ করার জন্যই এটি তৈরি করা হয়েছে। এ কারণে শাস্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মৌলিকত্ব এবং স্বতন্ত্রতা বজায় থাকবে। পদোন্নতি, শিক্ষক নিয়োগসহ সব ক্ষেত্রে প্রার্থীরা সিমিলারিটি ইনডেক্স করে আর্টিকেল জমা দেবে। এতে কোনো ফাঁকফোকর থাকার সুযোগ নেই। অতীতেও যারা ভুলভ্রান্তি করেছে, সেগুলো আমাদের এ নীতিমালার মধ্যে নির্ধারণ করা আছে। এ নীতিমালা করার আগে কোথাও যদি গবেষণা জালিয়াতি বা তথ্য চুরি হয়ে থাকে, সেগুলোকেও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘দ্য রুলস ফর দ্য প্রিভেনশন অব প্লেইজারিজম (চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধ নীতিমালা)’ শীর্ষক নীতিমালাটি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। এরপর সেটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে। এ নীতিমালা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ২০ ভাগ (একই উৎস বা সূত্র থেকে সর্বোচ্চ ২ ভাগ) পর্যন্ত অন্য লেখা থেকে কপি করলেও সেটি শাস্তিযোগ্য হবে না। এর বেশি মিল থাকলে জরিমানা, পদাবনতি, ডিগ্রি বাতিল থেকে চাকরিচ্যুতি পর্যন্ত শাস্তির মুখে পড়তে হবে দায়ী ব্যক্তিদের।

চূড়ান্ত নীতিমালা ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০ ভাগের বেশি তথ্যের মিল থাকলে শাস্তির মাত্রা তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। ২০ থেকে ৪০ ভাগ পর্যন্ত মিল থাকলে নিম্ন স্তর (লেভেল-১), ৪০ থেকে ৬০ ভাগ পর্যন্ত মিল থাকলে মধ্যম স্তর (লেভেল-২) এবং ৬০ ভাগের বেশি মিল থাকলে সর্বোচ্চ স্তর (লেভেল-৩) হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

থিসিস, গবেষণামূলক নিবন্ধ, মনোগ্রাফ বা প্রকল্প প্রতিবেদন কিংবা স্নাতক পর্যায়ের যে কোনো গবেষণায় লেভেল-১-এর অপরাধ করলে ডিগ্রি বা ক্রেডিট ছয় মাসের জন্য স্থগিতসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে ওই সময়ের মধ্যে অভিযুক্ত ফেলো, রিসার্চার বা গবেষককে সংশোধিত পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হবে। লেভেল-২-এর ক্ষেত্রে ডিগ্রি বা ক্রেডিট স্থগিতসহ ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে অভিযুক্ত পাণ্ডুলিপি সংশোধনে এক বছর সময় পাবেন। লেভেল-৩-এর ক্ষেত্রে ডিগ্রি বা ক্রেডিট দুই বছরের জন্য স্থগিতসহ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে সংশোধিত পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হবে।

অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংশোধিত পাণ্ডুলিপি জমা দিতে না পারলে লেভেল-১-এর ক্ষেত্রে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে ছয় মাস, লেভেল-২-এর ক্ষেত্রে ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে ছয় মাসের মধ্যে সংশোধিত পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হবে। উভয় ক্ষেত্রে ডিগ্রি বা ক্রেডিট স্থগিত থাকবে। বাড়তি সময়ের পরও সংশোধিত পাণ্ডুলিপি জমা দিতে ব্যর্থ হলে তার ডিগ্রি বাতিল বা অকার্যকর বলে গণ্য হবে। তবে লেভেল-৩-এর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংশোধিত পাণ্ডুলিপি জমা দিতে না পারলে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে রেজিস্ট্রেশন বাতিলসহ পরে ঢাবির কোনো প্রোগ্রামে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন না—এমন সিদ্ধান্তও নেওয়া হতে পারে।

আর অভিযুক্ত ফেলো বা গবেষক যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত (শিক্ষক, কর্মকর্তা বা গবেষক) হন এবং ওই গবেষণা কর্মের জন্য কোনো পদোন্নতি প্রাপ্ত হয়ে থাকেন বা আর্থিক সুবিধাভোগী হন, তাহলে আগের সব অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগারে ফেরত দিতে হবে। এ ছাড়া লেভেল-১-এর ক্ষেত্রে ২০ হাজার টাকা জরিমানাসহ ছয় মাসের মধ্যে সংশোধিত পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হবে। ব্যর্থ হলে ডিগ্রি বাতিল বা প্রত্যাহার করে পদাবনতি ও দুই বছরের জন্য পদোন্নতি বন্ধের শাস্তি পাবেন।

আর্টিকেল, নিবন্ধ, বই বা বইয়ের কোনো অধ্যায় প্রকাশের ক্ষেত্রে চৌর্যবৃত্তি হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি পরবর্তী দুই বছর কোনো পদোন্নতি পাবেন না। পাশাপাশি গবেষণামূলক কাজ তত্ত্বাবধান থেকে তাকে দুই বছর বিরত রাখা হবে। লেভেল-২-এর ক্ষেত্রে ডিগ্রি বাতিল বা প্রত্যাহারসহ পরবর্তী চার বছর কোনো পদোন্নতি পাবেন না। পাশাপাশি গবেষণামূলক কাজ তত্ত্বাবধান থেকে তাকে দুই বছর বিরত রাখা হবে। লেভেল-৩-এর ক্ষেত্রে ডিগ্রি বাতিল বা প্রত্যাহারসহ পরবর্তী ছয় বছর তিনি কোনো পদোন্নতি পাবেন না।

তিনটি ধাপেই গবেষণার তত্ত্বাবধায়ককে সতর্ক করা হবে। পাশাপাশি লেভেল-১-এর ক্ষেত্রে পরবর্তী দুই বছর, লেভেল-২-এর ক্ষেত্রে পরবর্তী তিন বছর এবং লেভেল-৩-এর ক্ষেত্রে পরবর্তী চার বছর গবেষণামূলক কাজের তত্ত্বাবধান থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হবে। এ ছাড়া তিনি যার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন, সে শিক্ষার্থীর জন্য সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো ফ্যাকাল্টি মেম্বারকে একাডেমিক কাউন্সিল মনোনয়ন দিতে পারবেন।

আর্টিকেল, নিবন্ধ, বই বা বইয়ের কোনো অধ্যায় প্রকাশ বা ছাপানোর সময় তথ্য চুরি করলে লেখককে তার আর্টিকেল, নিবন্ধ, বই বা বইয়ের কোনো অধ্যায় প্রত্যাহার করে নিতে হবে। সঙ্গে প্রকাশনার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের থেকে পাওয়া অর্থ ঢাবি কোষাগারে ফেরত দিতে হবে। যদি অভিযুক্ত ফেলো বা গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত (ফ্যাকাল্টি মেম্বার, কর্মকর্তা বা গবেষক) হন এবং ওই প্রকাশনার জন্য কোনো পদোন্নতি প্রাপ্ত হয়ে থাকেন বা কোনো আর্থিক সুযোগ-সুবিধাভোগী হন, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে সব অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগারে ফেরত দিতে হবে। প্রকাশিত আর্টিকেল, নিবন্ধ, বই বা বইয়ের কোনো অধ্যায় সরিয়ে নিতে হবে।

একাধিকবার তথ্য চুরি প্রমাণিত হলে শাস্তি:
গবেষণায় তথ্য চুরি পুনরাবৃত্তি হলে বিধান অনুযায়ী যে লেভেলে পড়বে, তার চেয়ে একধাপ বাড়িয়ে শাস্তি দেওয়া হবে। প্রকাশিত আর্টিকেল, নিবন্ধ, বই বা বইয়ের কোনো অধ্যায়ে চুরি পুনরাবৃত্তি হলে বিধান অনুযায়ী যে লেভেলে পড়বে, তার চেয়ে একধাপ বাড়িয়ে শাস্তি দেওয়া হবে। সঙ্গে পাণ্ডুলিপি সরিয়ে নিতে হবে। যদি তিনি ঢাবিতে কর্মরত হন, তাহলে যে অংশ তথ্য চুরির দায়ে অভিযুক্ত, তা সরিয়ে ফেলতে হবে। কোনো ব্যক্তি লেভেল-৩-এর অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলেই কেবল তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত করা হবে।

তবে শাস্তির নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে উপাচার্যের মাধ্যমে সিন্ডিকেটের কাছে শাস্তি পুনর্বিবেচনা বা পুনর্মূল্যায়নের আপিল করা যাবে। আর নীতিমালা প্রয়োগের সময় কোনো ধরনের অস্পষ্টতা দেখা দিলে সিন্ডিকেট সমস্যা সমাধানে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখবে। এ ছাড়া একাডেমিক কাউন্সিলের পরামর্শে এবং সিন্ডিকেটের অনুমোদন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নীতিমালায় যে কোনো সংশোধনের অধিকার রাখে।

নীতিমালা অনুযায়ী, যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, অনুষদের ডিন, বিভাগের চেয়ারম্যান বা ইনস্টিটিউটের পরিচালক বরাবর গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করতে পারবেন। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের সভায় ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ও তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এই নীতিমালা অবশ্যই বাস্তবায়নযোগ্য। এর ফলে এখন চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠলে ‘জানি না’ বলার সুযোগ থাকবে না। আশা করি, নীতিমালা কার্যকর করা যাবে এবং গবেষণায় এ ধরনের তথ্য চুরির প্রবণতা কমে আসবে।’

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল