• বুধবার ০১ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৮ ১৪৩১

  • || ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

বাংলাদেশ-জাপান বাণিজ্য বৃদ্ধির উদ্যোগ

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২৩ জুলাই ২০২৩  

বাংলাদেশ-জাপানের মধ্যে আগামী ৫০ বছরের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক কেমন হবে তার একটি ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেশকিছু কর্মপরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে বাংলাদেশ ও জাপান সরকার। আজ রবিবার দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকা আসছেন জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প বিষয়কমন্ত্রী নিশিমুরা ইয়াসুতোশি। তার সঙ্গে জাপানের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশ সফর করবেন। 
জাপানে প্রতিবছর রপ্তানি বাড়ছে, অন্যদিকে জাপানি বিনিয়োগ বাড়ছে এদেশে। কিন্তু বৈশ্বিক সংকট, শুল্ক-অশুল্কজনিত সমস্যা এবং নানা রকম চ্যালেঞ্জের কারণে কাক্সিক্ষত হারে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়েনি। অথচ বিরাট সুযোগ রয়েছে দুদেশের সামনে। 
আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটিতে বছরে ১ হাজার কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির স্বপ্ন দেখছেন উদ্যোক্তারা। একইভাবে মেট্রোরেলের মতো দেশের বড় বড় মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে চায় জাপান। শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ইকোনোমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (ইপিএ) করতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও জাপান। 
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-জাপান ইকোনোমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (ইপিএ) সম্পাদনের লক্ষ্যে যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনার জন্য দুদেশের মধ্যে জয়েন্ট স্টাডি গ্রুপ (জেএসজি) গঠন করা হয়েছে। জেএসজির দ্বিতীয় সভা আগামী ২৫-২৬ জুলাই বাংলাদেশের আয়োজনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে। এর আগেই জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প বিষয়কমন্ত্রী নিশিমুরা ইয়াসুতোশি ঢাকায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবেন। 
এর আগে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বা ৫০ বছর উদযাপন করেছে বাংলাদেশ-জাপান। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জাপান এগিয়ে আসে। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দেশটি বড় বড় বিনিয়োগ করেছে। ঢাকার যানজট মোকাবিলায় মেট্রোরেল ইতোমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এই মেট্রোরেলসহ আরও বড় বড় প্রকল্প জাপানের অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে। 
জাপানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ ৫০ বছরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ  শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জাপানের অর্থ বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী সফরের প্রথম দিনে জেট্রোর (জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন) উদ্যোগ একটি বিজনেস সামিটে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করবেন।  রাজধানীর প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের ওই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন এবং আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক অংশগ্রহণ করবেন। 
এছাড়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিডা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার জেবিসিসিআই, জাপানিজ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এ্যাসোসিয়েশনের (জেসিআইএডি) প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করবেন। এছাড়া সফরকালে তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে দেখা করে যৌথ সমীক্ষা নিয়ে আলোচনা করবেন। 
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, জাপানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আগামী ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশ এলডিসি থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে যাবে। ওই সময় যাতে জাপানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বা বিনিয়োগে কোনো সমস্যা তৈরি না হয় সে লক্ষ্যে ইপিএ করা হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আশা করছি. ২০২৫ সালের মধ্যে ইপিএ চুক্তি সই করা সম্ভব হবে। দেশটির অর্থ বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রীর এই সফরে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর  জোর দেয়া হবে। 
উল্লেখ্য, গত এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় প্রস্তাবিত ইপিএ বিষয়ে দুইদেশ একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। যৌথ সমীক্ষা চূড়ান্ত  করার পর ইপিএ নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হবে। বাংলাদেশ জাপান থেকে বছরে ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, বিপরীতে রপ্তানি করে দেড় বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এর আবার বেশিরভাগ তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল। এর পাশাপাশি চিংড়ি, লেদার, লেদার ফুটওয়্যার, পাটজাতপণ্য, ক্যামেরা পার্টস, জুট ইয়ার্ন এবং টুয়াইন প্রভৃতি রপ্তানি হয়ে থাকে।  এছাড়া দেশটি থেকে আমদানি করা হয়- আইরন ও স্টিল, মোটরযান, মেশিনারিজ, কপার, ইলেকট্রিক এ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স, ফটোগ্রাফিক অ্যান্ড সিনোমেটোগ্রাফিক পণ্য প্রভৃতি।

জানা গেছে, কক্সবাজারের মাতারবাড়ি ঘিরে জাপানি শিল্পাঞ্চল গড়তে সমন্বিত উন্নয়ন উদ্যোগ (মিডি) বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে উভয়দেশ। নতুন এই শিল্পাঞ্চল গড়তে জাপানের পক্ষ থেকে ৭ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হতে পারে। মূলত এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাপান তাদের ‘বিগ-বি’ প্রস্তাব কার্যকর করতে চায়। মাতাবাড়ি ঘিরে জাপানি শিল্পাঞ্চল বাস্তবায়নে গ্রহণ করা হয়েছে সমন্বিত উন্নয়ন উদ্যোগ-মাতারবাড়ি ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ বা মিডি। এই মিডিকে কেন্দ্র করে জাপান অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের বড় সুযোগ তৈরি হবে। 
জাপানের এই উপস্থিতি আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি বাংলাদেশ-জাপানের সেতুবন্ধনকারী হিসেবে জাপান সরকার কর্তৃক রাইসিং সান এ্যাওয়ার্ড পুরস্কার পেয়েছেন জেবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের উপদেষ্টা আব্দুল হক। তিনি জানান, জাপান বরাবরই বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনের পরই বঙ্গবন্ধু জাপান সফর করছিলেন। জাপান সরকারও তাকে সহযোগিতার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সেই উদ্যোগে ভাটা পড়ে।

তবে বর্তমান বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা দুইদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে মাইলফলক হিসেবে কাজ করছে। ঢাকার মেট্রোরেল, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণসহ বড় বড় অবকাঠামোখাতে দেশটি বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নে দ্রুত জাপানের বিগ-বি প্রস্তাব বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন। 
বাণিজ্য বাড়াতে হবে অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি (ইপিএ) ॥ বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি বা ইপিএ বিষয়ে সম্মত হয়েছে জাপান। অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে যাতে বাংলাদেশ এলডিসি  থেকে স্নাতক হওয়ার পর বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখে। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, জাপান প্রধান উন্নয়ন এবং বাণিজ্য অংশীদার। সুতরাং, আমাদের পণ্যগুলো সেখানে প্রতিযোগিতামূলক হয় এবং আমরা জাপান থেকে আরও বিনিযোগ করতে পারি তা নিশ্চিত করা এখন গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া চীন থেকে সরে এসে জাপানি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায়। তবে এক্ষেত্রে অবকাঠামোখাত এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হওয়া প্রয়োজন। 
এদিকে, পণ্য ছাড়াও সেবা ও বিনিয়োগ খাতেও জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। গত পাঁচ দশকে দেশটি বাংলাদেশকে নানাভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। বিশেষ করে জাপান বাংলাদেশে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল, মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে যা বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশেষভাবে সাহায্য করছে। জাপান এখন বাংলাদেশের বড় রপ্তানি বাজারও। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে  বাংলাদেশের পোশাকের চালান দশগুণ বেড়ে ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে ইপিএ স্বাক্ষর করতে এবং আরও জাপানি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে বাংলাদেশকে তার বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার ওপর জোর দেওয়ার ওপর তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 
গত এক দশকে বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানির সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে বর্তমানে ৩৩৮-এ পৌঁছেছে। বেশিরভাগই তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য চেষ্টা করছে এবং বিনিয়োগকারীরা ইপিএ স্বাক্ষর করার ব্যাপারে তাগিদ দিচ্ছেন। অনেক জাপানি কোম্পানি তাদের ব্যবসা জাপান এবং চীন থেকে অন্য দেশে স্থানান্তর করছে। বাংলাদেশ এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেও মনে করেন উদ্যোক্তারা। জাপানের বিনিয়োগকারীর বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল