• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

অপেক্ষায় আছি কার্যকর সংসদের

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯  

আফরোজা পারভীন, কথাশিল্পী, কলাম লেখক, সম্পাদক

আফরোজা পারভীন, কথাশিল্পী, কলাম লেখক, সম্পাদক

একাদশ সংসদ নির্বাচন সমাপ্ত হলো ৩০ ডিসেম্বর। এরইমধ্যে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। জাতীয় পার্টি এবার বিরোধী দলের ভূমিকায়।

গত সংসদে দলটি একসাথে বিরোধী দল আবার মন্ত্রীসভাতেও ছিল। তাই দলটির অবস্থান আসলেই স্পষ্ট ছিলো না। ছিলো নিষ্ক্রিয় ও প্রশ্নবিদ্ধ। স্বয়ং রওশন এরশাদ একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘তার কাছে মানুষ জানতে চায় তারা কী সরকারি দল না বিরোধী দল’! যাক এবার অন্তত আর এ ব্যাপারটা নেই। এরশাদ এখন বিশেষ দূত নেই। এটাও এক জাতীয় স্বস্তির!

নির্বাচনে বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট যে এতোটা খারাপ ফলাফল করবে সেটা সত্যিই ভাবা যায়নি। তারা ফল ভালো করবে না, এটা জানা ছিল। কিন্তু সেটা যে এতোটা খারাপ তা অভাবনীয় ছিল। বিশেষ করে বিএনপির অবস্থা বড়ই করুণ। একাধিকবার সরকারে থাকা এই দলটির যে এতটাই দৈন্যদশা তা নির্বাচন না হলে বোঝা যেতো না। যদি ধরেও নি, তাদের অভিযোগের ভিত্তি আছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, তাহলে সুষ্ঠু হলে ৫টা আসনের জায়গায় কতটা পেতো তারা? ১৫ টা ৫০টা, তার বেশি কী পেতো? আসল কথা হচ্ছে, বিগত দশ বছরে একটিবারের জন্যও তারা কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। তাছাড়া প্রথম থেকেই নির্বাচনের ব্যাপারে সিরিয়াস ছিলো না তারা। নির্বাচনে আসবে কী আসবে না এই সিদ্ধান্ত নিতেই অনেক সময় পার করে ফেলেছে । বিএনপির নেতারা বার বার বলছিলেন, তারা নির্বাচনে যাচ্ছেন আন্দোলন জোরদার করার জন্য। অর্থাৎ নির্বাচনে জেতার কোনো ইচ্ছে বা চেষ্টা তাদের ছিলো না। আর সে প্রচেষ্টাও দেখা যায়নি। কোথাও বিএনপির একটা পোস্টার বা প্রচারণা আমরা দেখিনি। তাদের প্রচারণায় বাধা দেয়া হয়েছে শুনেছি, কিন্তু সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় সড় কোন ঘটনা, ডাইরি বা মামলার কথা শুনিনি।

বিচ্ছিন্ন দু চারটি সমাবেশ ছাড়া ব্যাপকভাবে জনসভা বা জনসংযোগ করতেও তাদের দেখা যায়নি।

প্রার্থী নির্বাচন নিয়েও তাদের ছিল নানান ঝামেলা। এক এক সিটে চার পাঁচ জনকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল । তারপর একে একে বাদ দেয়া হচ্ছিল। এর নেপথ্যের কারণ কী? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তারা মনোনায়ন বাণিজ্য করেছেন। ব্যাপারটা কী তাহলে তাই! বিএনপির বেশ ক’জন নাম করা এবং জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। তারা দাঁড়ালে জেতার সম্ভাবনা ছিল। কী এক অজ্ঞাত কারণে সেটা করা হয়নি।

ঋণখেলাপী হওয়া ও মামলা মোকদ্দমার কারণে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি কয়েকজন ভালো প্রার্থী। আরো অদ্ভুত ব্যাপার, মওদুদ আহমদ ভোট দিতে যাননি । তাকে পুলিশ প্রহরায় ভোট দেয়ার প্রস্তাব দিলেও তিনি রাজি হননি।

বিএনপির সাথে জামাতের সংশ্লিষ্টতা এদেশের সচেতন মানুষ কোনদিন ভালো ভাবে নেয়নি বা নেবেও না। এদেশের মুক্তিযুদ্ধে জামাতীদের ভূমিকা সবার জানা। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর যুদ্ধাপরাধের বিচার করে আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধা আর শহিদ পরিবারগুলোর প্রাণের দাবি পূরণ করেছে। সে কারণে এবারও জামাতকে সাথে নিয়ে বিএনপির নির্বাচন, বিশেষ করে ড. কামাল হোসেনের মতো একজন প্রগতিশীল মানুষের সাথে জামাতীদের থাকাটা মোটেও পছন্দ করেনি জনগণ।

আওয়ামী লীগের গত দুই মেয়াদে যেমন অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে, তেমনি সমালোচনা করার মতো অসংখ্য ঘটনাও রয়েছে । ঘুষ, দুর্নীতি, আত্মতোষণ, প্রশ্নপত্র ফাঁস, যানজট একসিডেন্ট, খুন জখম রাহাজানির ঘটনা কিছু কম ঘটেনি। বিচার না পাবার ইতিহাসও লম্বা হয়েছে। প্রতিনিয়ত ভুগতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে । কিন্তু এত রকমের অরাজকতাও কিন্তু ‘হাওয়া ভবনে’র স্মৃতিকে এদেশের মানুষের মন থেকে ম্নান করে দিতে পারেনি। ম্নান করতে পারেনি বাসে বোমা মেরে দিনের পর দিন মানুষ মারার ঘটনা। আর নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে ১২টা চ্যানেলে একইসাথে দেখানো হয়েছে ‘দহন’ নামের চলচ্চিত্রটি। বলে না দিলেও এ দেশের মানুষ জানে একটা বিএনপি আমলে বোমা ছুঁড়ে মানুষ মারার কাহিনি নিয়ে নির্মিত। ছবিটি দেখে মানুষের মনে জেগে উঠেছে পুরোনো ক্ষত। মনের পর্দায় ভীতি নিয়ে ভেসে উঠেছে বিএনপির আমলের দুঃশাসনের চিত্রগুলো। অনেক ভোট কমে গেছে বিএনপির । আবার তার দিন কয়েক আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জীবন ও কর্ম নিয়ে নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র ‘ হাসিনা: অ্যা ডটার’স টেল’ মুক্তি পায় বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে। এ ছবি দেখে দেশের জনগণ একজন ইস্পাত কঠিন নেত্রীর জীবনের মানবিক দিক, তাঁর দুঃখ যন্ত্রণা, স্বজন হারানোর বেদনা নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছে। ভোট বেড়েছে আওয়ামী লীগের।

একের পর এক ফাঁস হয়েছে বিএনপির হেভিওয়েট নেতাদের ফোনালাপ। সেই আলাপে কখনও উঠে এসেছে তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের কথা, কখনও সহিংসতা করার আভাস বা নির্দেশ। মানুষ যেমন পছন্দ করে না দেউলিয়াকে তেমনই পছন্দ করে না সহিংসতা। ফোনালাপগুলি বিএনপি আমলের সহিংসতাকে আবারো সামনে এনে দিয়েছে।

খালেদা জিয়া প্রায় এক বছর ধরে কারাগারে। স্বাভাবিকভাবে নেতা কর্মীরা বিভ্রান্ত। তারেক জিয়া বিদেশে । সামান্য কিছু খারাপ মানুষের কাছে ছাড়া তারেক জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা কখনই তেমন ছিলনা। কোকো মারা গেছে। নির্বাচনের আগে শোনা গিয়েছিল, ড. জোবাইদা দেশে আসবেন। রাজনীতিতে নামবেন। জিয়া পরিবারের মধ্যে একমাত্র এই মহিলারই সুনাম আছে। তিনি সুশিক্ষিত মার্জিত বিনয়ী সুদর্শনা । অভিজাত পরিবারের মেয়ে তিনি। তিনি এসে বিএনপির হাল ধরলে মরা গাঙে হয়ত কিছুটা হলেও বান ডাকতে পারত। কিন্তু তিনি আসননি। কারণ নানাবিধ হতে পারে। কিন্তু আসলে যেটি ঘটেছে তা হচ্ছে জিয়া পরিবারের কেউই পাশে না থাকাতে দেশের ভোটাররা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, বিএনপি জিতলে কে প্রধানমন্ত্রী হবে, খালেদা তো জেলে, তারেক বিদেশে এই প্রশ্ন ছিল গ্রাম-গঞ্জের মানুষের। আর এটাতো সত্যি, যে নের্তৃত্ব খালেদার পক্ষে দেয়া সম্ভব সেটা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বা রিজভী সাহেবের পক্ষে দেয়া সম্ভব না। আর সেটা জনগণ মানবেও না।

এদেশের রাজনীতি এখনও উত্তরাধীকার সূত্র ধরেই চলছে। আওয়ামী লীগ বলতে মানুষ শেখ পরিবার আর বিএনপি বলতে জিয়াউর রহমানের পরিবারকেই বোঝে। কাজেই দলের শীর্ষ বা সরকারের শীর্ষে এ দুই দলের যে কোন নেত্রীকেই মানুষ দেখতে চায়। সেই নেত্রীর একজন যখন কারাগারে থাকেন তখন ভোটারের মনে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়।

এমন নানাবিধ কারণে ভরাডুবি ঘটেছে বিএনপির। আর এই অবস্থা থেকে খুব সহজে তারা উত্তরণ ঘটাতে পারবে বলেও মনে হয়না। বিএনপির ও গণফোরামের সংসদ সদস্যরা শপথ নেননি। শপথ না নিয়ে তারা কী অর্জন করবেন সেটাও বোধগম্য নয়।

বিরোধীদল বিহীন সংসদ দৃষ্টিকটু। বিরোধী দলের কাজ সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে সঠিক পথে চালিত করা। এবার অবশ্য জাতীয় পার্টি বিরোধী দল। তাদের আসন ২২ টি, নৌকা প্রতীকে ওয়ার্কাস পার্টির আসন ৩, জাসদের ২, বাংলাদেশ জাসদের ১, তরিকত ফেডারেশন ১, বিকল্প ধারা ২, এছাড়া বাই সাইকেল প্রতীকে (জাপি মঞ্জু )১।

আওয়ামী লীগের বাইরে মোট প্রাপ্ত আসন ৩০। তার মাঝে ৮টি আওয়ামী লীগের শরিক ১৪ দলের। সংসদে জাতীয় পার্টি যে খুব জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে তা অতীত অভিজ্ঞতা বলে না। বাকিরা এখন কেমন ভূমিকা নেন সেটাই দেখার। ১৪ দল থেকে মন্ত্রী না নেয়ায় ইতোমধ্যেই কিছু ক্ষোভের কথা শোনা যাচ্ছে। ঐক্যফ্রন্ট ( বিএনপি ও গণফোরাম) সংসদে না যাওয়ায় বড়ই কমজোর হবে এ সংসদ। অন্যান্য নির্বাচনে বেশ কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থীকে আমরা জয়ী হতে দেখি। এবার তাও নেই। দুঃখের বিষয় এটাই যে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও সংসদ বোধহয় অংশগ্রহণমূলক হবে না। নব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রথম সংসদ বসছে আগামী ৩০ জানুয়ারি। এই সংসদে সংরক্ষিত আসনের এমপিরাও অংশ নেবেন বলে জানা গেছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি একটি কার্যকর সংসদের।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল