• শনিবার ০৪ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২০ ১৪৩১

  • || ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

চাপের মুখে বিএনপি

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১৬ অক্টোবর ২০২৩  

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র আড়াই মাস বাকি। এখনো দেশের দুই বড় দল নির্বাচন ইস্যুতে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। বিএনপি বলছে, নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। তবে এ অবস্থানের কারণে ঘরে-বাইরে চাপের মুখে বিএনপি। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তারা চায় সংবিধানের আলোকে সুষ্ঠু নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সকল প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। তবে  বড় দুই দলের মধ্যে সমঝোতা চায় ইসি। আর এ সমঝোতার জন্য বিদেশীরা চায় সংলাপ।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করতে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। বড় দুই দলের মধ্যে সমঝোতা করে যাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় এটা চায় তারা। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দেশী-বিদেশী সর্বমহলকেই আশ্বস্ত করছে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য যা যা করার সবই করা হবে। কিন্তু বিএনপি আওয়ামী লীগের এ আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছে না। তাই তারা ঘুরেফিরে একই কথা বলছে নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। তবে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে ভেতরে ভেতরে বিভিন্ন মহল কাজ করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন কাছে এসে পড়ায় বিএনপির ওপর ঘরে-বাইরে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সবাই বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে বলছে। আবার দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও যে কোনো ভাবেই হোক নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। তাদের যুক্তি, যেভাবে সারাবিশ্ব এবারের নির্বাচনে চোখ রাখছে তাতে এবার সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। তাই নির্বাচনে না গেলে স্থানীয় পর্যায়ের সাধারণ নেতাকর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। আবারও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে দলটি। এতে দল দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকরাও বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পর্যালোচনা করছেন। তাদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, বিএনপি নির্বাচনে না গেলে দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রথমত : বিএনপি অংশ না নেওয়ার পরও যদি অন্যান্য দলগুলোর অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যায় তাহলে আরও ৫ বছর বিএনপিকে জাতীয় সংসদের বাইরে থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত : নির্বাচন বর্জন করে রাজপথে সহিংসতা করতে গেলে একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে। অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের কবলে পড়তে হতে পারে। এসব নিয়ে চাপের মধ্যে রয়েছে দলটি।

এদিকে দেশের বড় দুই দলের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানকে কিছুটা নমনীয় করে সব দলকে নির্বাচনমুখী করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল দেশে ফিরে ৫ দফা প্রস্তাব সংবলিত একটি বিবৃতি দিয়েছে। এ বিবৃতিতে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিপরীতমুখী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের ওপর জোর দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সংলাপের প্রস্তাবের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কোনো শর্ত না দিলে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের চিন্তা করা হবে। শর্তযুক্ত সংলাপের ব্যাপারে আমাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সুষ্ঠু নির্বাচনের সুপারিশ নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। ওগুলো নিয়ে আমরা সবাই একমত। সংলাপ তো একপক্ষ করবে না। এখন বিএনপি যদি মনে করে সংলাপ করবে, সেটা তাদের ব্যাপার। তবে বিএনপি বলছে, তারা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চায়। এ ছাড়া তারা বলছে সংসদ ভেঙে দেওয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ। আমরা তো এসব শর্তযুক্ত সংলাপে রাজি নই।

এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে সংলাপের আয়োজন করলে আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে বসতে রাজি। তবে দলীয় সরকারের  অধীনে আমরা নির্বাচনে যাব না। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছি। এ দাবি আদায় করেই ঘরে ফিরব। পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন আমাদের আন্দোলনে সাহস জোগাচ্ছে।

এদিকে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তিনি বলেছেন, এ সমঝোতার উদ্যোগ রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার দায়িত্ব ইসির নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সংলাপের প্রস্তাবের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে রবিবার আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বিএনপিকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা চাই সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসুক। আমরা চাই বিএনপি নির্বাচনে আসুক। আমরা ভোট সুষ্ঠু করব ইনশাআল্লাহ।

সংবিধান অনুসারে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও এ নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয় সে বিষয়ে বার বার সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের অন্য মন্ত্রীরাও তাই বলছেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও তা বলা হচ্ছে। এ পর্যন্ত যত বিদেশী প্রতিনিধি দল এসেছে, তাদের সঙ্গে বৈঠককালেও সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। আর সংবিধানে নির্বাচনের বিষয়টি সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকায় বিদেশীরাও এর বাইরে কোনো কথা বলেনি। তবে তারা বার বারই বলেছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা। নির্বাচন কমিশনও বলছে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা করার তারা সবই করবেন। তবে বিএনপি চায়, দলীয় সরকারের পরিবর্তে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। এ দাবিতে তারা রাজপথে আন্দোলনের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের দ্বারে দ্বারে যাওয়া অব্যাহত রেখেছে।

বছরখানেক আগে থেকেই বিএনপি বলে আসছে, বর্তমান সরকারের অধীনে আর নির্বাচনে যাবে না। এ জন্য তারা তখন থেকেই বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করা থেকে বিরত রয়েছে। গতবছর ১০ ডিসেম্বর থেকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না এমন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু করে। সেইসঙ্গে বিএনপি ও এ দল সমর্থিত সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ পরিষ্কার করতে ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে দেন-দরবার বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশ এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে চিঠি পাঠাতে শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার বিষয়ে তাগিদ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সংবিধানের মধ্যে থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দেওয়া হয়। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকেও সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচনের কথা বলা হয়নি।

বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলসহ সকল অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করে। এ সংলাপে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও বিএনপিসহ তাদের সমমনা ক’টি দল যায়নি। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সবসময়ই বলছেন, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার জন্য ইসি মুরুব্বিয়ানা করতে পারবে না। তাদের মধ্যে যদি মত-পার্থক্য থাকে, সেটা তারা নিজেরাই  নিরসন করার চেষ্টা করতে পারেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকারের শুভাকাক্সক্ষী দেশী-বিদেশী মহল বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন করতে যা যা প্রয়োজনÑ তা করার জন্য সরকারও নির্বাচন কমিশনকে তাগিদ দিচ্ছে। এ কারণে সরকার কঠোর অবস্থানে না গিয়ে এখন বিএনপিসহ রাজপথের বিরোধী দলগুলোকে অবাধে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে। আবার বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে নির্বাচনের পক্ষে যারা কাজ করছেন, তাদের পরামর্শে বিএনপি এখন রাজপথের কঠোর আন্দোলন থেকে কিছুটা সরে এসেছে। তবে সংলাপ বা কোনো সমঝোতা না হলে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপি কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল সংলাপের ওপর গুরুত্ব দেওয়ায় জাতীয় নির্বাচনকে সমনে রেখে রাজনীতিতে ফের সংলাপের বিষয়টি আলোচনায় স্থান পেয়েছে। দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের বিষয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিভিন্ন মহল এ দু’টি দলের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। পর্দার অন্তরালে থেকে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল দুই দলকে এক টেবিলে বসানোর চেষ্টা করছে। তাদের মতে এক টেবিলে বসানো গেলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। আর তা করা গেলে বড় দুই দল এবং দেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্যই মঙ্গল।

অভিজ্ঞ মহলের মতে, দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন বিদ্যমান আইনে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে সবাইকে আস্থায় নিয়ে সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থা করতে পারবে। তাই সংলাপ হোক আর না হোক বিএনপির উচিত নির্বাচনে অংশ নেওয়া। তা না হলে, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত অধিকাংশ দল নির্বাচনে অংশ নিলে সে নির্বাচন সাংবিধানিক বৈধতা পাবে। কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ পর্যন্ত দেশে যত বিদেশী প্রতিনিধি দল ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক এসেছেন, তারা কেউ বিএনপির মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেননি। আর সংবিধানের বাইরে গিয়ে এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ারও তাদের নেই। তাই দেড় দশক ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি আরও ৫ বছর পিছিয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে দলের সাধারণ নেতাকর্মীরাও হতাশ হয়ে পড়বেন।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল