• শনিবার ১১ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৮ ১৪৩১

  • || ০২ জ্বিলকদ ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

অলৌকিকতার স্মৃতিতে আজও বিরাজমান চন্দ্রার দিঘি

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২৭ মে ২০২৩  

চন্দ্রাবতীর স্মৃতিমাখা গ্রাম চন্দ্রা। এ গ্রামের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বয়ে চলেছে ঝিনাই নদী। যা এখন মৃত। লোহিত বর্ণের শক্ত মাটির কোল ঘেঁষে যে নদী একদা আষাঢ়ে অথৈ পানিতে ছলছল করতো। দু’কোল ভাসিয়ে সিক্ত করতো ফসলের মাঠ। শ্যামল শোভায় মন জুড়াতো। পাখির কিচিরমিচিরে হৃদয়-মন-ভরে যেতো নৈসর্গিক সৌন্দর্যে। চন্দ্রাবতীর স্বর্গীয় প্রস্থানের বহুকাল পরেও রূপালি চাঁদের মতো তার স্মৃতি আজও জ্বলজ্বলে।
জামালপুরের দেউরপাড় চন্দ্রা এলাকায় বিশাল দিঘিটি সেখানকার সবচেয়ে প্রাচীনতম দিঘি। লালমাটির এ দিঘিটির মাটির সঙ্গে মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়ের লালমাটির সাদৃশ্য রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কবে এ দিঘি খনন করা হয়েছে তা নিয়ে কোনো প্রমাণ না থাকলেও দিঘির সৃষ্টির ইতিহাস নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন লোকগাথা।

অনেকে মনে করেন, নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর শাসনামলে এ অঞ্চলের একজন প্রভাবশালী হিন্দু ব্যক্তি হরিশচন্দ্র দেউরপাড় চন্দ্রা, তীর্থ চন্দ্রা, হাট চন্দ্রার দেওয়ানি লাভ করেন। যার পরিধি ছিল জামালপুরের কালিবাড়ি থেকে কোর্ট স্টেশন পর্যন্ত।

জনশ্রুতি রয়েছে যে, চন্দ্রাবতীর বয়স যখন ৬ বছর রাজা হরিশচন্দ্র দিঘি খননে মনোনিবেশ করেন। চন্দ্রা বড় হয়ে সখীদের নিয়ে ঐ দিঘির জলে জলকেলি খেলায় মেতে থাকবে। যৌবনের উষ্ণতা দিঘির শীতল জলে প্রশান্ত হবে। মাটির গহীন তলদেশ পর্যন্ত খনন করেও রাজার আশা পূরণ হয়নি। জলের দেখা মেলেনি দিঘিতে।

বিশিষ্ট প্রবন্ধকার মোস্তফা বাবুল তার কাব্যে উল্লেখ্য করেছেন, রাজা হরিশচন্দ্র স্বপ্ন দেখেন জল দেবতাকে। স্বপ্নে দেখা দিয়ে জল দেবতা বলেন, শর্ত মানলে দিঘি তোমার কানায় কানায় জলে ভরবে। রাজা শর্ত জানতে চাইলে জল দেবতা বলেন, দিঘির তলায় তোমার পত্নী কমল রাণীকে বিসর্জন দিলে দিঘি জলে পরিপূর্ণ হবে। চমকে উঠেন রাজা হরিশচন্দ্র। এ কী করে সম্ভব। ‘না- না গো জল দেবতা ফিরিয়ে নাও তোমার বাণী, দিঘির চেয়ে প্রিয় আমার কমল রাণী।’ রাজা চিৎকার করে উঠেন। নিদ্রা ভেঙে গেলে রাজা দেখেন তার পাশেই বসে আছেন কমল রাণী। হতচকিত রাজা নির্বাক তাকিয়ে থাকেন কমল রাণীর দিকে।

কমল রাণী জিজ্ঞাসা করেন- কি হয়েছে স্বামী। ওসব কি বললে, চোখে জল গড়িয়ে পড়ে রাজার। বললেন- স্বপ্নের কথা বলতে আমার খুব ভয় লাগছে। কমল রাণীর পীড়াপীড়িতে অবশেষে হরিশচন্দ্র রাজা স্বপ্নের কথা খুলে বললেন কমল রাণীর কাছে। সতি পত্নী কি দিতে পারবে স্বামীর মাথা উঁচু রাখতে আত্ম বলিদান?

কমল রাণী বললেন- পতিব্রতা আমাকে দাও বলিদান। রাজা রাজি না হলে কমল রাণী আহার নিদ্রা ছেড়ে দিয়ে মরণ নেশায় ডুবে গেলেন- শয্যাশায়ী হলেন অচিরেই। স্বপ্নে দেখা জল দেবতাকে হরিশচন্দ্র রাজার মনে হয়েছে কুসংস্কারের দেবতা বলে। প্রিয়তমা পত্নী কমল রাণী অনাহারে-অনিদ্রায় মরণপথের যাত্রী হলেন। তাকে বাঁচিয়ে তুলতে রাজা প্রানান্ত চেষ্টা করে চললেন। কোনো ভাবেই কমল রাণী সুস্থ হয়ে উঠলেন না। 

চিকিৎসকরাও ব্যর্থ হলো অবশেষে। শয্যাশায়ী কমল রাণী জীবন্মৃত অবস্থায় পড়ে রইলেন। শেষে রাজার কাছে রাণীকে বিসর্জন দেওয়ার আকুল মিনতি জানান প্রজারাও। হতোদ্যম রাজা পত্নীর মায়া ত্যাগ করলেন। দিঘির তলায় চিতা সাজানো হলো। কমল রাণীকে চিতার আগুনে জীবন্ত দাহ করা হলো জল দেবতার উদ্দেশ্যে। 

দিঘির তলায় চিতায় পুড়ে কমল রাণী ছাইভস্ম হয়ে গেলেন। দিন পেরিয়ে মাস যায় তবুও দিঘিতে জলের দেখা মেলে না। রাণীর বিসজনেও দিঘি ভরলো না জলে। বিমর্ষ রাজার চোখে জলের ধারা নামে পত্নী বিয়োগে। অবশেষে আষাঢ়ে দিঘি পূর্ণ হলো জলে। মাতৃহারা চন্দ্রাবতী দিঘির পাড়ে বসে কাঁদে, জলের দিকে চেয়ে থাকে। মা তার দিঘিরতলায় গভীর জলে ডুবে আছে- দেখা মেলে না মায়ের।

নানা অলৌকিক ঘটনার কারণে দিঘিটির রয়েছে লোকগাথা। কথা হয় ঐ গ্রামের বাসিন্দা বাহাউদ্দীন খান সঙ্গে। তিনি জানান- প্রাচীনকালে বিয়ে বনভোজন, মিল্লাতসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে ভোজসভার আয়োজন হলে দিঘিটির পাড়ে কেউ থালা, বাসন, হাঁড়ি, পাতিল চাইলে দিঘি থেকে উঠে আসতো থালা, বাসন, হাঁড়ি, পাতিল। আর সেগুলো ব্যবহারের পর দিঘিতে পুনরায় ভাসিয়ে দেওয়ার নিয়ম ছিল। কোনো এক লোভী ব্যক্তি ওসব হাঁড়ি, পাতিল, থালা, বাসন দিঘিতে না ভাসিয়ে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখলে সেই অলৌকিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়৷ ঐ সব হাজারো কল্পকথা নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে টিকে রয়েছে জামালপুরের চন্দ্রা দিঘিটি।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি মঞ্জুরুল হক ফজলু বলেন, আমরা এখানে ১৪ পুরুষ ধরে বসবাস করছি। বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছি হরিশচন্দ্র রাজা দিঘিটি খনন করেছেন। কথিত আছে- এলাকায় পানির সঙ্কট দেখা দিলে তিনি দিঘিটি খনন করেন। দিঘিটি পাকিস্তান আমল থেকেই ব্যক্তি মালিকানায় রয়েছে৷ তবে প্রাচীন লোকগাথা, ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবকিছু মিলিয়ে সরকারি উদ্যোগ হাতে নিলে দিঘিটি হতে পারে জামালপুরের  আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

জামালপুর পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, জন্মলগ্ন থেকেই চন্দ্রা দিঘির কথা নানাজনের কাছে শুনে আসছি। শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই চলে যান দিঘির পাড়ে। তাছাড়া যুবক-যুবতী, প্রেমিক-প্রেমিকাসহ সব বয়সী মানুষের পদচারণা রয়েছে দিঘির পাড়ে। এ স্থানটি জামালপুরের সর্ববৃহৎ পর্যটন কেন্দ্রে গড়ে উঠলে ভ্রমণ পিপাসুদের তৃষ্ণা মেটাবে।

ঝিনাই পাড়ের চন্দ্রাবতীকে নিয়ে কাহিনী কাব্যে রচনা করেছেন চন্দ্রা গ্রামের কবি ও ছড়াকার মোহাম্মদ ইসমাইল। এছাড়াও গীতি, কবিতা, নাটক রচিত হয়েছে চন্দ্রাবতীর কাহিনী অবলম্বনে। প্রবীণ সাংবাদিক মোস্তফা বাবুল রাজা হরিশচন্দ্রের এ দিঘি নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। চন্দ্রাবতীর কাহিনির স্থান পেয়েছে বহু কবিতার পাতায়।

রাজা হরিশচন্দ্রের সেই রাজ্য নেই, তবে রাজা যে দিঘি খনন করেছিলেন, তার অস্তিত্ব আজও বিরাজমান। চন্দ্রা দিঘি নামে দেউরপাড় চন্দ্রা গ্রামের গাছগাছালি ঘেরা সেই দিঘিই চন্দ্রাবতীর স্মৃতিটুকু আজও বাঁচিয়ে রেখেছে। চন্দ্রাবতীর প্রেম কাহিনি এবং হরিশচন্দ্র রাজার দিঘি খননের এ উপাখ্যান জামালপুরের  লোক সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল