• মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৭ ১৪৩১

  • || ১২ জ্বিলকদ ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইলে ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে মালঞ্চ সিনেমা হলটিও

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১৭ জানুয়ারি ২০২৩  

প্রযুক্তির উন্নয়নে বিলুপ্তির পথে রুপালী পর্দা। নব্বই দশকেও বড় পর্দায় সিনেমা দেখাটা বাঙালির ঐতিহ্য ছিল। ছুটির দিন কিংবা উৎসবে পরিবারের সবাই মিলে হলে যাওয়াটা শখের বিষয় ছিল। অবসরে সিনেমা দেখে মনে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতো। কিন্তু প্রযুক্তির তৈরী “ কম্পিউটার ও মোবাইলের ব্যবহার ছিনতাই করেছে সেই সিনেমাশিল্পকে।
সিনেমা ব্যবসায় ধসের কারনে টাঙ্গাইল শহরের সিনেমাপ্রেমী দর্শকের বিনোদনের শেষ সিনেমা হল মালঞ্চ সিনেমা হলটিও ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৮ তারিখে থেকে সর্বশেষ বড় পর্দার বিনোদনের মাধ্যম মালঞ্চ সিনেমা হল ভাঙ্গার কাজ শুরু হয়েছে। সর্বশেষ সিনেমাটি হলটি যখন ভাঙ্গা হয় তখন এই সিনেমা হলে আন্ডারওয়াল্ড সিনেমাটি প্রদর্শিত হয়েছে।
১৯৭৫ সালে ৩০ শতাংশ জমির উপর বাসাইল উপজেলার ময়থা গ্রামের বাসিন্দা আতাউর রহমান মানিক তার ৩ ভাই বজলুর রহমান হীরা, লুৎফর রহমান ছানা ও ফয়জুর রহমান মাখনকে নিয়ে শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে নির্মান করেন “মালঞ্চ সিনেমা হল” নায়ক ওয়াসীম ও ভিলেন জসীমের জিঘাংসা সিনেমা দিয়ে বড়পর্দাটি চালু হয়। যদিও মালঞ্চ সিনেমাটির ১৯৭২ সালে শহরের প্যাড়াডাইসপাড়ায় গুদাম ঘর ভাড়া নিয়ে মালঞ্চ সিনেমা হল চালু করেন। আতাউর রহমান মানিকদের দেশের বাড়ী বাসাইল উপজেলা ময়থা গ্রামে সাধুলীপাড়ায়। শুরুতে তারা ৪ ভাই টাঙ্গাইল শহরে বাসা ভাড়া করে থাকতেন আর ভিক্টোরিয়া রোডে (বর্তমান কিছুক্ষণ হোটেল) সুরুটি হোটেল চালাতেন।
স্বাধীনতার পর সুরুচির নিকটবর্তী রওশন সিনেমা হলের মালিক মোজাহারুল ইসলাম চৌধুরী লেবু যখন তার অধীনে মির্জাপুর অনামিকা সিনেমা হল ছেড়ে দিতে চাইলেন তখন তারা দুই ভাই মির্জাপুর হলটি দায়িত্ব নিয়ে নিলেন এবং নতুন করে নাম দিলেন মুক্তা সিনেমা হল। বছর দুই ব্যবসা করার পর মালঞ্চ সিনেমা হল চালু করেন। ২০০০ সালের দিকে সিনেমা ব্যবসা পড়তির দিকে আসতে থাকে।
ভালো মানের সিনেমা তৈরী না করে নোংরা সিনেমা তৈরীতে যখন বাজার সয়লাভ তখন রুচিবান দর্শকরা সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সিনেমা পাইরেসী ছাড়াও বিনোদনের মাধ্যম মোবাইল ধীরে ধীরে মানুষের আস্থা অর্জন করতে থাকে। তখন মালঞ্চ সিনেমা হলটি প্রবাসী নাফিজ আহমেদ জুয়েল নামে এক ব্যাক্তির নিকট বিক্রি করে দেন আতাউর রহমান মানিক ভাইয়েরা। মালঞ্চ হলে চাকরী করতেন জাহিদ মন্ডল। তিনি প্রবাসী মালিক জুয়েল কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে সিনেমা হল চালাতে থাকেন। প্রায় বছর দশেক হল সিনেমা ব্যবসায় লোকসান গুনেও সরকারের সহযোগিতার আশায় ব্যবসা চালিয়েছেন। তখন টাঙ্গাইল শহরে একটি সিনেমা হল। প্রথমে রওশন রুপসী, তারপর রুপবানী সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেলো।
২০১৯ সালে বন্ধ হয়ে গেলো কেয়া সিনেমা হল। বাকী ছিল মালঞ্চ সিনেমা হল, সেটাও বন্ধ হয়ে হারিয়ে গেলো । এখন সিনেমা হলের পরিবর্তে ১০ তলা মালঞ্চ টাওয়ার স্থাপিত হচ্ছে। আসিতেছে, চলিতেছি পরির্বতে মালঞ্চ হলের সামনে সাইনবোর্ডে লেখা“ নিজের বাড়ি নিজে গড়ি, অর্ধেক টাকা সাশ্রয় করি” জমির শেয়ার বিক্রি চলছে। মালঞ্চ হলের প্রাক্তন মালিক জাহিদ মন্ডলের মাধ্যমে জানা গেছে ৬ কোটি টাকা এটা বিক্রি হয়ে গেছে। এখানে সিনেমা হল না থাকলেও মালঞ্চ নামটি হারিয়ে যাবে না । টাওয়ারের মাঝে “মালঞ্চ” নামটি টিকে থাকবে। তবে বড় পর্দায় একটি সিনেমা দেখার আশা এখন করা যাবে না। অনেকেই হয়ত বড় পর্দায় সিনেমা দেখতে এসে মালঞ্চ টাওয়ার দেখে মনে কষ্ট নিয়ে ফিরে যাবে। তখন অনেকের মনেই টাঙ্গাইল শহরে একটি সিনেমা হল বা সিনেপ্লেক্স খুবই প্রয়োজন এটা উপলদ্ধি করবে।
হারিয়ে যাওয়া সিনেমা হল, সেই সিনেমার পরিবেশ পরিবেশ কেউ ফিরিয়ে দিবে না। তখন সিনেমা দেখতে অনলাইনই ভরসা কিংবা ছুটে যেতে হবে ঢাকা। টাঙ্গাইলের সিনেমা হল এখন অতীতের গল্প। যে গল্প বইয়ের পাতায়, অনলাইনের পাতায় থাকবে। পাঠকরা হয়ত সেটা পড়ে জানার চেষ্টা করবে হারিয়ে যাওয়া সিনেমা হলের কথামালা।
সিনেমা প্রেমী দর্শক গনেশ সাহা বলেন“ হারাধনের শেষ সম্বল মালঞ্চ সিনেমা হলটি হারিয়ে গেলো! এখন মন চাইলেই বড় পর্দায় সিনেমা দেখা কিংবা যে কোন উৎসবে নতুন সিনেমা মুক্তি পেলে তা দেখার কোন উপায় থাকবে না। এটা বড়ই দুঃখের কথা”।
বাংলা সিনেমা দেখার একনিষ্ট দর্শক রিক্্রাওয়ালা হাতেম বলেন“ মনে আউস পাইলে বড় ঘরে সিনেমা দেখি, এখন আর দেখতে পারুম না, একথা ভাবতেই কষ্ট লাগে”।
সাধারণ গ্রন্থাগারের সাধারণ সম্পাদক কবি মাহমুদ কামাল বলেন“ আমাদের শৈশব কৈশোরে একটা বড় বিনোদন ছিল সিনেমা হল। যদিও এই মুহুর্তে সিনেমা হলে যাওয়া হয় না। তবে মনে সেই সিনেমা দেখার স্মৃতি আজও অমলিন। সিনেমা হল বেসরকারী মালিকানা, এটা ভেঙ্গে ফেললে কারো করার কিছু নাই, তবে সরকার পক্ষ যদি বড় পর্দায় সিনেমা দেখার ব্যবস্থা চালু রাখতো,তাহলে এই শিল্প টিকে থাকতো”।
টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক জাফর আহমেদ বলেন“ এক সময় আমরা দলবেঁধে সিনেমা দেখতাম। আমাদের সময়ে অবসরে সিনেমা দেখ ছিল একটা বিনোদন। যা আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। টাঙ্গাইলের শেষ সিনেমা মালঞ্চ হারিয়ে গেলে টাঙ্গাইলের বিনোদনপ্রেমী মানুষ বড় পর্দায় সিনেমা দেখার সুযোগ পাবে না। বিশেষ করে খেটে খাওয়া গরীব মানুষগুলো একটু বিনোদনের জন্য সিনেমা হলে যেত, এখন হল না থাকায় তারা সহ অনেকেই হতাশ হবে। সরকার যদি প্রতিটি জেলায় সিনো কমপ্লেক্স তৈরী করে দেয় তাহলে এই সিনেমা শিল্প টিকে থাকবে”।
টাঙ্গাইল জেলা তথ্য অফিসের সহকারী পরিচালক তাহলিমা জান্নাত বলেন, তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে সিনেমা হলের সংখ্যা কমছে। জেলায় ৫১টি সিনেমা হল ছিল। শহরে একটি সিনেমা হল ছিল এখন তাও ভেঙ্গে ফেলা হলো। সিনেমাকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের নানা পরিকল্পনা রয়েছে। প্রত্যেক জেলায় একটি করে সিনো কমপ্লেক্স নির্মান করার পরিকল্পনা রয়েছে।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল