• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে ডাক্তার হওয়ার পথে গোপালপুরের সুচিত্রা

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২৩ অক্টোবর ২০১৯  

দু’চোখে তার অজস্র লোনা জল ভর করেছিল। ফুঁপিয়ে কান্নায় অক্ষগোলক থেকে তা অবিশ্রান্ত ঝঁরছিল। সে অশ্রুধারা ঝঁরণার মতো নিরবধি বঁয়ে চললে নীল কষ্টের নদী হতো। সাগর থেকে মহাসাগরে ছঁড়িয়ে বাস্পাকারে ভেঁসে বেড়াতো তা আকাশময়। কিন্তু গরীবের কান্নার উত্তাপ কম। সংকীর্ণ ব্যাপ্তিতেই তার নিঃস্বরণ। দ্রুত জমা বাঁধতে তাই কঁসুর করেনা। কিন্তু কিছু কান্না হৃদয়কে মথিত করে। কর্ণ থেকে মস্তিস্কে এবং শেষাবধি প্রখর অনুভূতির স্টেমসেলে শক্ত করে গেঁথে যায়। আর সেটিই মানবিকতাবোধ জাগ্রতে অণুপরমাণুর মতো কাজ করে।

সেদিন ছিল শুক্রবার। বেলা দ্বিপ্রহরে যখন ওদের কুটিরে পৌঁছলাম, সাথে ছিলেন জনাকয়েক মিডিয়া শিষ্য। বাইরে থেকে চঁকচঁকে টিনের চৌঁচালা দেখে যতোটা স্বাবলম্বি মনে হয়েছিল, ভেতরে গিয়ে মিললো ততোটাই দীনতার ছাঁপ। দিন এনে দিনে খাওয়ার স্পষ্টাভাষ। কিন্তু আমাদের অপরিচিতি, অচেনাঅজানাকে সহসাই জয় করে নিলো ওরা। যেন কতো কালের আত্মপরিচয়, আত্মজন আমরা। যেটি গরীবরা খুব তাড়াতাড়ি পারে, সেরকমটি করায় আমরা বিস্মিত হলাম।

বলছিলাম সুচিত্রা রাণীর কথা। সুচিত্রা সেন না হলেও মেধামনণে আমাদের সুচিত্রা অনণ্য। পর্ন কুটিরে সুচিত্রার জন্ম হলেও নিজস্ব মেধা ও স্বাতন্ত্রে সে বিকাশমান। আমাদের সুচিত্রার বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার ধোপাকান্দি ইউনিয়নের সাহাপুর গ্রামে। বাবা সদ্য প্রয়াত সন্তোষ চন্দ্র ধর। মা মুক্তি রাণী। সন্তোষ ছিলেন পল্লী চিকিৎসক। বাড়ি থেকে দেড়শ গজ দূরে ধোপাকান্দি মোড়ে ছিল ওষুধের ছোট্র দোকান।

বাড়িতে মুক্তিরাণীর মিনি পোল্ট্রি খামার। শুধুই বসতভিটে। নেই এক কানি আবাদী জমি। দুই কণ্যা সন্তান প্রিয়ঙ্কা আর সুচিত্রাকে নিয়ে সংসারে তেমন স্বচ্ছলতা না থাকলেও কোনোভাবে খেয়েপরে বেঁচেবর্তে যেতেন। কিন্তু গত ১০মে সন্তোষ স্ট্রোক করে স্বর্গীয় হন। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এ অকস্মাৎ প্রয়াণ পরিবারটিকে বিপর্যয়ে ফেলে। দারিদ্র্যতার জন্য প্রিয়ঙ্কাকে আগেই স্বামী ভাগ্যে সমর্পিত করা হয়।

সন্তোষের নির্মল স্বপ্ন ছিল কণিষ্ঠা সুচিত্রাকে নিয়ে। মেয়ে ডাক্তার হবে। মানুষের সেবা করবে। পল্লী চিকিৎসক হিসাবে সন্তোষ গাঁগেরামে প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় যে ভালোমানসি অর্জন করেছিলেন, তার বৃহৎ বিমূর্ত চেতনার ছাঁয়া সুচিত্রার জীবনে প্রতিফলিত করানোর স্বপ্ন এঁকেছিলেন। কিন্তু সন্তোষের স্বর্গীয় লাভের পর, মেধাবী সুচিত্রার ভাগ্য বর নিয়ে এখন টানাটানি করছে নির্মম দারিদ্র্যতা।

জনান্তিকে এতো কথা বলা এজন্য যে, প্রয়াত বাবার স্বপ্নের নাগাল পেয়েছে সুচিত্রা। কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাশের পর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুবর্ণ সুযোগ তথা ডাক্তার বনার সুযোগ মিলেছে।

নিজের জন্য, পরিবারের জন্য এ সুখবরের বার্তা স্বর্গীয় সুখের স্পর্শ এনেছিল। কিন্তু দিন যতোই যাচ্ছে অর্থাভাবে সে স্বপ্ন ফিঁকে হয়ে যাচ্ছে সুচিত্রার।

কারণ প্রথমত ভর্তি, এরপর বেসিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয় অতঃপর ধারাবাহিক পড়ালেখার নূণ্যতম খরচটা এক্কেবারে কম নয়। কিন্তু কিভাবে জুটবে তা? মা মুক্তি রাণীর যে মিনি পোল্ট্রি ফার্ম, তা থেকে বেঁচাবিক্রিতে তো দুবেলা খাবারই জোটেনা। তাহলে কিভাবে চলবে সুচিত্রার ডাক্তারী পড়ালেখা?

মেয়ের ডাক্তারী পড়ালেখার খরচ চালানোর দুশ্চিন্তায় বিধবা মুক্তি রাণী যেন শেকল বন্দী । দুর্ভাবনায় স্বাস্থ্য ক্ষয়ে যাচ্ছে।

স্বামী হারানোর বেদনা ভুলে, মেয়েকে মানুষ করার যে সুবর্ণ সুযোগ, তা হাতছাড়া হয়ে গেলে বাঁচবেন কিভাবে? দাড়াবেন কোথায়? স্বপ্নের মরণ হলে বেঁচে থাকার মানে কোথায়?

দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই করে সফলতার অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে সুচিত্রা। ডাক্তার হবার যে সোনালী স্বপ্ন দুচোঁখ ভরে এঁকেছিল আমাদের সুচিত্রা, সেই স্বপ্নকে আজ ব্যঙ্গ করছে দারিদ্র্যতার নির্মম কষাঘাত।

ছবিতে দেখুন সুচিত্রার স্বপ্ন ভঙ্গের কান্না। যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তার প্রয়াত বাবা। মানুষ হবার সেই স্বপ্ন, বাবার মতোই সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার ভাবনায় বিভোর সুচিত্রা।

পৃথিবীতে বাবারা যে কতো আপন হয়, তা সন্তানরা বুঝতে পারে বাবা হারানোর পর। সুচিত্রা তার বাবাকে হারিয়ে বাবার স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার লড়াই করছে। সেই স্বপ্নের অকাল মৃত্যূর আশঙ্কায়, সেদিন সুচিত্রার দু চোঁখে ছিল সাগরভর্তি লোনাজল। সেই লোনাজলের ভারীত্ব বহনের ধৈর্য দেখে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে ছিলাম। পরিমাপ করছিলাম, সুচিত্রার কষ্টের অতলান্ত কতোটায়।

দারিদ্র্যতা মানুষকে মহান করে, সাহসী করে, সংযমী করে। দারিদ্র্যতার সাথে মেধার সমন্বয় হলে প্রতিকূলকে অনুকূলে আনা যায়। আত্মপ্রত্যয়ী সুচিত্রা সেটা হয়তো পারবে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় একটি স্বপ্নকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার আহ্বান।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল