• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

সঞ্চালনের বাধা কাটছে

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ৬ মে ২০২৪  

উষ্ণ আবহাওয়া আর দ্রুত শিল্পায়নের প্রভাবে দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করতে দেশে নির্মিত হয়েছে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রও। দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প হিসেবে স্থান পেয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। চলতি বছর শেষেই উৎপাদনে আসার জন্য প্রস্তুত কেন্দ্রটি। কিন্তু উৎপাদন শুরু হলেও এর থেকে জাতীয় গ্রিডে আনার জন্য সঞ্চালন লাইন তৈরি নিয়ে শঙ্কা রয়েই গেছে। যদিও এর স্থলভাগের প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ, কিন্তু নদী পারাপারের কাজ এগিয়েছে মাত্র ২৬ শতাংশ। নদীর ওপর টাওয়ার স্থাপনের কাজ শুরুই হয়নি। কাজটি অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং দাবি করে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কঠিন হলেও ডিসেম্বরের আগেই নদী পারাপারের কাজ শেষ করার জন্য পুরোদমে চেষ্টা চলছে।

পিজিসিবি জানিয়েছে, রূপপুর পারমণাবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন তৈরির কাজ সাতটি প্যাকেজের মাধ্যমে চলছে। এর মধ্যে রূপপুর থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত ৬৫ দশমিক ৩১ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজের অগ্রগতি শতভাগ। আমিনবাজার থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৯০ শতাংশের বেশি। রূপপুর থেকে ঢাকা (আমিনবাজার-কালিয়াকৈর) ১৪৭ কিলোমিটার নির্মাণকাজ হয়েছে শেষ হয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটারের অগ্রগতি ৭০ শতাংশের মতো, ধামরাই পর্যন্ত ১৪৫ কিলোমিটারের অগ্রগতি ৬০ শতাংশের কিছু বেশি, বগুড়া পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটারের অগ্রগতি ৬০ শতাংশের মতো এবং নয়টি বে-এক্সটেনশন নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৩০ শতাংশের ওপরে। সব মিলিয়ে স্থলভাগের প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে জানিয়ে প্রকল্পের পরিচালক মো. মাসুদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এখন ছোট ছোট কিছু কাজ বাকি রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি টাওয়ার নির্মাণ হচ্ছে। টাঙ্গাইলে এবং ভেড়ামারার কাজ চলছে। বাকিটাও শেষ হয়ে যাবে। আর কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের শতভাগ কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করছি।

তবে প্রস্তুত যখন স্থলভাগের সঞ্চালন লাইন, তখন অনেকটাই পিছিয়ে রিভার ক্রসিং কাজের অগ্রগতি। এ প্যাকেজে যমুনা ও পদ্মা নদীতে ৪০০ ও ২৩০ কেভির ১৬ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে যমুনা নদীর ওপর সাত কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হবে। আর পদ্মা নদীতে হবে দুই কিলোমিটার লাইন। ১ম ইউনিটের জন্য পদ্মা নদীতে রিভার ক্রসিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে ২৬ শতাংশ। সম্প্রতি জনকণ্ঠকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম গাউছ মহীউদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, এর সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ সময়মতো শেষ করার জন্য প্রতিদিন রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করছি। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। তাদের লক্ষ্য, চলতি বছরের ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসার। আমরাও সঞ্চালন লাইন তৈরিতে সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি। আমাদের এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জিং ছিল নদী পারাপার লাইনটি। প্রথম ইউনিটের জন্য পদ্মা রিভার ক্রসিংয়ের চারটি টাওয়ারের কাজ হচ্ছে। এর মধ্যে স্থলভাগে দুটি টাওয়ারের কাজ চলছে। নদীর মধ্যে আছে দুটি টাওয়ার। সেই দুটি টাওয়ারের কাজ শুরু হবে মে মাসে। নদী পারাপারের লাইন নির্মাণের জন্য টাওয়ার স্থাপনের কাজ নদীতে অনেক ঝুঁকি নিয়ে করতে হয়। এ জন্য বিদেশ থেকে একটি বিশেষ হ্যামার নিয়ে আসতে হয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তা প্রকল্প এলাকায় পৌঁছে যাবে। সময়মতো সব যন্ত্রপাতি না পাওয়ায় কাজ কিছুটা দেরি হলেও পদ্মা নদী পারাপারের কাজ ইতোমধ্যে প্রায় ২৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি। পদ্মা নদীর কাজ শেষ হওয়ার পর আগামী বছরে দ্বিতীয় ইউনিট চালু হওয়ার আগেই যমুনা নদী পারাপারের কাজ শেষ হবে বলেও দাবি করেন তিনি।

পাবনার রূপপুরে দেশের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পটিতে চলছে এখন শেষ মুহূর্তের কাজ। রাশিয়ার অর্থায়নে কেন্দ্রটি নির্মাণের কাজ চলছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে। চলতি বছরের অক্টোবর বা ডিসেম্বরেই পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হতে পারে কেন্দ্রটিতে। আগামী বছর এই প্রকল্প থেকে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হবে বিদ্যুৎ উৎপাদন। এতে করে দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা অনেকটাই মিটবে। এর দ্বিতীয় ইউনিটটি উৎপাদনে যাবে পরের বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালে।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, এ প্রকল্পটি চালু করার সময় যে বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে, তা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে নেওয়া হবে। প্রকল্প এলাকায় এই বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রস্তুতির কাজও এগিয়ে চলছে। এর প্রথম অংশের কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। অক্টোবরের আগে বাকি কাজও শেষ হবে। চূড়ান্তভাবে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার আগে আগামী অক্টোবর বা ডিসেম্বরে কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার উদ্ভাবিত থ্রিজি (+) ভিভিইআর ১২০০ রিঅ্যাক্টর স্থাপন করা হয়েছে এখানে। এর জ্বালানিও সরবরাহ করবে রাশিয়া। গত বছর অক্টোবরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম বুঝে পেয়েছে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞ তৈরি ও তাদের প্রশিক্ষণের কাজও করছে রাশিয়া। প্রকল্পটি চালুর পর পাঁচ-ছয় বছর বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে রাশিয়ার বিশেষজ্ঞরাই এটি পরিচালনা করবেন। পরে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার দায়িত্ব বুঝে নেবেন বলে।

দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কথা থাকলেও কোভিড, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনীহাসহ নানা কারণে এ প্রকল্পের গতি ধীর হয়েছে। বর্তমানে তবে সব জটিলতা কাটিয়ে এখন পুরোদমে চলছে সঞ্চালন লাইন তৈরির কাজ। এতে করে নির্ধারিত সময়েই কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলে আশা করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে রূপপুরের সঞ্চালন লাইনের কাজ পিছিয়ে গিয়েছিল। তবে আবার কাজ চলছে পূর্ণোদ্যমে। ইতোমধ্যে স্থলভাগের কাজ শেষের দিকে। নদী পারাপারের কাজও নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি। আমাদের লক্ষ্য, কেন্দ্রটি উৎপাদানে গেলেও যেন সঞ্চালন লাইনের কারণে বসে না থাকে। যেমনটি হয়েছিল পায়রায়। যদিও নদী পারাপারের কাজটি চ্যালেঞ্জিং। তবু আমাদের কর্মীরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।

চলতি বছরের ডিসেম্বরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে জানিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানও বলেন, নির্ধারিত সময়ের আগে সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ করা নিয়ে সংশয় থাকলেও এটির কাজ দ্রুত শেষ করতে সমন্বিতভাবে কাজ করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উইং বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির নির্মাণকাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ও তদারকি করছে। এর আগে সঞ্চালন লাইন তৈরি করতে না পারায় প্রায় দেড় বছর বসিয়ে রাখতে হয় পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে। জরিমানা গুনতে হয় মাসে মাসে। একই শঙ্কা ছিল রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়েও। তবে এখন আর শঙ্কা নেই জানিয়ে ইয়াফেস ওসমান বলেন, কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।

প্রসঙ্গত, সঞ্চালন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল একনেকে অনুমোদন পায়। মোট ১০ হাজার ৯৮২ কোটি টাকার মধ্যে ঋণের আওতায় আট হাজার ২১৯ কোটি টাকা দিচ্ছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। বাকি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার ও পিজিসিবি।

রূপপুরের সঙ্গে সংযুক্ত সঞ্চালন লাইনের অন্যান্য কাজে ইন্ডিয়ান লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) ঋণ থাকলেও প্রকল্পের নদী পারাপারে অর্থায়ন থেকে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ। বর্তমানে পিজিসিবি সরকারের কাছ থেকে রিভার ক্রসিংয়ের জন্য ৬২৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে এ ঋণ অনেক আগেই অনুমোদন হলেও অর্থছাড়ের জন্য যে পরিমাণ ডলার প্রয়োজন তা ছাড় করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি এ অর্থছাড়ের বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থছাড় হলে রিভার ক্রসিংয়ের কাজ আরও দ্রুত শেষ হবে বলে দাবি করছে পিজিসিবি।

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ প্রকল্পে সিংহভাগ অর্থায়ন দিয়েছে রাশিয়া। এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে রাশিয়ার অর্থায়ন রয়েছে ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্পের এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিটের সক্ষমতা মোট দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। চলতি বছরে প্রথম ইউনিটের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর রূপপুর প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কংক্রিট ঢালাইয়ের মধ্য দিয়ে রূপপুর প্রকল্পের মূল পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। পরবর্তী বছর ২০১৮ সালের ১৪ জুলাই প্রকল্পের দ্বিতীয় ইউনিটের কংক্রিট ঢালাই উদ্বোধন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুটি ইউনিটেরই কংক্রিট ঢালাই কাজের উদ্বোধন করেন।

পূর্বনির্ধারিত সিডিউল অনুযায়ী ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট এবং ২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল। সিডিউল অনুযায়ী ২০২৪ সালের ১৩ অক্টোবর প্রথম ইউনিট আর ২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর দ্বিতীয় ইউনিট চূড়ান্ত হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিডিউল অনুযায়ী কাজ এগোতে না পারায় চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রথম ইউনিটের উৎপাদন শুরু করার বিষয়ে আশাবাদী প্রকল্প কর্মকর্তারা।

এদিকে, প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর পর এই একই স্থানে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। দ্বিতীয় প্রকল্পটিও বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিচ্ছে রাশিয়া। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রোসটাম প্রধানের প্রাথমিক আলোচনাও হয়েছে। এখন চলছে প্রাথমিক নিরীক্ষা-সমীক্ষার কাজ।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল