• মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

  • || ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

‘লিভিং ঈগল’ গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম মৃত্যুবরণ করেছেন

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১৫ জুন ২০২০  

‘লিভিং ঈগল’ গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। রোববার সকালে ঢাকার মহাখালি ডিএসএইচও’র তার নিজ বাস ভবনে তিনি ইন্তেকাল করেন।  তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। দীর্ঘদিন তিনি নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন।

 

জানা যায়, ১৯৬৭ সালের ৫ জুন অপরিপক্ক ও অপরিনামদর্শী মিশরের পুরো এয়ার পাওয়ার ফ্যাসিলিটিকে মাটিতে মিশিয়ে দেয় ইজরায়েল। একদিনেই সকাল থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রায় ৪০০ টা কমব্যাট এয়ারক্রাফট, মোস্টলি সোভিয়েট মেড মিগস, ধ্বংস হয়ে যায় আরব ফোর্সের। সিরিয়া ও মিশর এর অবস্থা ত্যানা। জর্ডানের অল্প কিছু ব্রিটিশ মেড হকার হান্টার থাকলেও পর্যাপ্ত পাইলট নাই। ইজরাইলি সেনাপতি মোশে দায়ান দুপুরের মধ্যে তাদের সুপারসনিক ফ্রেঞ্চ ফাইটার জেটগুলোকে জর্ডানের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। এসময় ঘটল সবচেয়ে আনেক্সপেক্টেড ঘটনাটা। কিং হুসেইনের দাওয়াতে পাইলট ট্রেনিং দিতে ইস্ট পাকিস্তানের এক বাংগালি পাইলট ৬ মাস ধরে জর্ডানে অবস্থান করছিলো। তাকে ফ্রন্টলাইনে লিড দেবার অনুরোধ করে জর্ডান। তিনি তা এক্সেপ্ট করেন। পরবর্তী দুদিন ইজরাইলের জন্য রীতিমত আজরাইল হয়ে ওঠেন আকাশে।

 

৬ দিনের একপাক্ষিক এই ধ্বংসযজ্ঞে মাত্র দুবার তিনি সুযোগ পান আকাশে ইজরাইলি পাইলটদের মুখোমুখি হবার। দুপুরে জর্ডানের এয়ারবেসে ইজরাইলি আক্রমণের মিনিট খানেক আগে তিনজন সাথী নিয়ে উড়াল দেন এই বাংগালী পাইলট। আল-মাফরাক এয়ারবেজের সীমানা পার হতে না হতেই ডগফাইট শুরু হয়। ফ্রেঞ্চ মিসটেয়ার-৪ মডেলের একটা ইজরাইলি এয়ারক্রাফট প্রথম কয়েক সেকেন্ডেই পাইলটসহ ভূপাতিত হয়। আরো দুইটা পলায়নরত ইজরাইলি এয়ারক্রাফটকে ফুল স্পিডে ধাওয়া করেন তিনি। আরো এক ইজরাইলি বিমান তার হাতে ধ্বংস হয়। তার আরেক সাথীর হাতে ইজরাইলের আরেক বিমান ভূপাতিত হয়। ইজরাইলের এই মিশনে পাঠানো ৬ টি বিমানের ৩ টি ধ্বংস হয়। এরপরও ইনডিসক্রিমিনেট বোম্বিং এর ফলে মাফরাক এয়ার বেস ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জর্ডানের ২৪ টা বিমানের বেশীরভাগই গ্রাউন্ডে ছিল এবং ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়। দিন শেষে দেখা গেল আকাশে লড়ায়রত ৪ বিমান ছাড়া আর সেরকম কিছুই বাকি নাই।

 

আম্মানে যেয়ে ল্যান্ড করেন এই পাইলট। শুধু রিফুয়েলিং এবং গান রিলোডের জন্য কয়েক মিনিট মাটিতে থেকে আবার উড়াল দেন। যাহোক সেদিনের এই অসম যুদ্ধে জর্ডান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও ইজরাইলের জন্য বিরাট এক শক ছিল এই বাংগালী পাইলট। আরবদের এত ক্ষিপ্রতা এত যোগ্যতা কবে থেকে এটা তারা বুঝে উঠতে পারছিলনা। জর্ডানের সমস্ত এয়ারবেসগুলো কমবেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আম্মান এয়ারপোর্ট সিভিলিয়ান এয়ারক্রাফট ও রানওয়েও বোম্বিং এর মুখে পড়ে। এমনকি ইউএন ফ্লাগধারী বিমানের উপরও গুলি বর্ষণ করে ইজরাইল। যাহোক, যেহেতু জর্ডানে থেকে খুব আর লাভ নাই, কিং হুসেইন এই পাকিস্তানী পাইলটকে ইরাকে চলে যাবার অনুরোধ করেন। ইজরাইলের নেক্সট টার্গেট ইরাক।

 

সকালে তাকে ডেকে তুলে ৪ পাইলটের টিম লিড দেবার জন্য রিকেুয়েস্ট করে ইরাক। তিনি একজন জর্ডানি এবং দুজন ইরাকী পাইলটকে সংগী হিসেবে বেছে নেন। এয়ারবেসে যেয়ে রেডি হতে হতে তারা খবর পান ইজরাইলি এয়ারফোর্সের এক বড় এয়ারক্রাফট বহর ইরাকের দিকে এ্রপ্রোচ করছে। সংগীদের নিয়ে উড়াল দিয়ে আকাশে আবার দ্বিতীয়বারের মত ইজরাইলের মুখোমুখি হন তিনি।

 

লড়ায় শুরু হয়। প্রথম কয়েক মিনিটেই ইজরাইলের একটা মিরাজ ফেলে দেন তিনি। উনার এক আরব সাথী আনন্দে চিল্লিয়ে ওঠে। স্যার নাউ উই গট দ্য পার্টি! ইটস টাইম টু সেলেব্রেট! সেলেব্রেট না করেই নিচের দিকে তাকিয়ে দু হাজার ফুট নিচে একটা ইজরাইলি ফ্রেঞ্চ মেড ভাটুর বোম্বারকে স্পট করেন তিনি। দ্রুত ম্যানুভার দিয়ে ঈগলের মত ক্ষিপ্র গতিতে নিচের দিকে নামতে থাকেন তিনি। উইদিন সেকেন্ডস এই ইজরাইলী বোম্বারের নাগাল পেয়ে যান। এত দ্রুত এত কাছে চলে আসেন যে দ্বিধায় পড়ে যান যে শ্যুট করবেন কিনা। কারন এই বড় সাইজের বিমান বিস্ফোরিত হলে ডেবরিতে তার নিজের জেটও ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। হি ডিড ইট এনিওয়ে।

 

সিক্স ডে ওয়ারে আরব ফোর্সের ৪৫০ বিমান ধ্বংস হয়। বেশীরভাগই রানওয়ে অথবা টারমাকে আনপ্রিপিয়ারড ও এক্সপোজড অবস্থায় থাকার কারনে। ইজরাইল হারায় ৪৬ টি যার ৪ টি একাই ভূপাতিত করেন সেই পাকিস্তানি পাইলট।

 

ক্যারিয়ার জীবনে খুব সফল ছিলেন শুরু থেকেই। আমেরিকার এরিজোনা লুক এয়ার বেসে পাকিস্তান এয়ারফোর্সের বাছাইকৃত পাইলটদের ট্রেনিং এ অংশ নিয়ে টপ অফ দ্য ক্লাস হন। জর্ডান এবং ইরাক তাকে মিলিটারি এওয়ার্ড দিয়ে সম্মানিত করেছে। পাকিস্তান দিয়েছে থার্ড হাইয়েস্ট মিলিটারি এওয়ার্ড সিরাত-ই-জুরাত। ২০০১ এ আমেরিকা তাকে অন অফ দ্য লিভিং ইগলস (গোটা দুনিয়ায় মাত্র ২২ জন) এর স্বীকৃতি দেয়। এক ফাইটে এত কম সময়ে ইজরাইলের এতগুলো বিমান ধ্বংসের রেকর্ড আজ পর্যন্ত আর কারো নাই। চারটা দেশ পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক এবং সবশেষ বাংলাদেশের এয়ারফোর্সে তিনি কাজ করেছেন। লড়েছেন ভারত এবং ইজরাইলের বিরুদ্ধে। ১৯৬৫ তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তার বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ সিরাত-ই-জুরাত (বাংলাদেশের বীরবিক্রম সমতুল্য) উপাধী দেয়া হয়। এই যুদ্ধে এক ডগফাইটে ভারতের একটি বিমান ভূপাতিত করেন তিনি।

 

বিমান বাহিনী সূত্রে জানা যায়, সাইফুল আজমের জানাযা সোমবার বাদ জোহর বিমান বাহিনী হ্যাঙ্গারে অনুষ্ঠিত হবে। জানাযা শেষে তাকে বিমান বাহিনীর কবরাস্থানে দাফন করা হবে।

 

১৯৪১ সালে পাবনা জেলার খগড়বাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সাইফুল আজম। উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পাশ করে ১৯৫৬ সালে উচ্চতর শিক্ষার্থে পশ্চিম পাকিস্তান যান। ১৯৬০ সালে জিডি পাইলট ব্রাঞ্চের একজন পাইলট হন তিনি।

 

১৯৭১ সালের পূর্বে তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দেন।

 

পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় ১৯৬৭ সালের ৬ জুন তাকে ইরাকি বিমান বাহিনীতে বদলি করা হয়। বিমানঘাঁটি আক্রমণের সময় তিনি পশ্চিম ইরাকে ছিলেন।

 

সাইফুল আজম তার বর্ণাঢ্য জীবনে নিজেই কিংবদন্তির ইতিহাস রচনা করেছিলেন। পৃথিবীর ২২ জন “লিভিং ঈগলের” মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।

 

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল