• বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৫ ১৪৩১

  • || ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

হিজড়াদের নিয়ে ইসলাম ধর্ম যা বলে !

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২০ ডিসেম্বর ২০১৯  

বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গ হিজড়াদের নিয়ে সরকারি কোনো কার্যক্রম নেই: আদমশুমারিতে তাদেরকে গণনা করা হয় পুরুষের কাতারে আবার কখনো নারীদের কাতারে।

 

পুরুষ হলেও আমরা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ি নারী হলেও পড়ি- এমনটি দাবি করে আসছে ‘বাধন হিজড়া সংঘ’ নামের হিজড়াদের একটি সংগঠন। এই সংগঠনটি আরো দাবি করে যে, সরকারের কাছে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর হিসেব আছে, আছে প্রতিবন্ধীদেরও আলাদা হিসেব। আমাদের বেলায় এসবের কিছুই নেই। এমন দাবিদাওয়া চলতেই থাকে। অতঃপর গত ১১ নভেম্বর ২০১৩ইং সন সোমবার বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদে উত্থাপিত হিজড়াদের নারী-পুরুষের পাশাপাশি আলাদা লিঙ্গ বা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতির বিলটি পাশ হয়েছে। স্বীকৃতি পরবর্তী নির্দেশ জারি করা হয় যে সার্টিফিকেট, ভিসা, বীমা, ব্যাংক সর্ব ক্ষেত্রে লিঙ্গ নির্ণয়ে তৃতীয় লিঙ্গের অপশন রাখতে হবে এবং তাদের পরিচয়ে হিজড়া-ই লিখতে হবে; অন্য শব্দ নয় । এ স্বীকৃতি হিজড়াদের জন্য সুখের।

 

বিভিন্ন ধর্মে হিজড়ার অবস্থান

ধর্ম মানুষের জন্য। ধর্ম মানে যুগে যুগে ভৌগলিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে যথাযোগ্য পরিবেশ পরিমণ্ডল থেকে মানুষের জীবন চলার পথের কতিপয় বিধানাবলি, যা পালনে মানুষ শান্তিতে বাস করতে পারে। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইহকাল ও পরকালে সর্বাঙ্গীন কল্যাণ সাধনে যে বিধানের প্রভাব অনস্বীকার্য, তাই হলো ধর্ম। আর ধর্মীয় বিধানের আলোকে মানব জীবনের গতির বিকাশ ঘটে। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম লিঙ্গ প্রতিবন্ধি সম্পর্কে কী বলে দেখা যাক।

 

হিন্দু ধর্মে হিজড়া:

দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে সাধারণত হিজড়া নামে অভিহিত করা হয়। হিন্দু দর্শনে তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে এই ধরনের মানুষকে আলাদাভাবে পুরুষ বা নারী হিসেবে বিবেচনা করা হতো না। তাদেরকে জন্ম সূত্রে তৃতীয় প্রকৃতি হিসেবে গণ্য করা হতো। তাদের কাছ সাধারণ নারী-পুরুষের মতো ব্যবহার প্রত্যাশা করা হতো না। তাদের ধর্মবিশ্বাস মতে যে নারী তার নারীত্বকে মূল্যায়ন করে না, তারাই পরজন্মে হিজড়া হয়, যেসব পুরুষ তার পুরুষত্বের সঠিক মূল্যায়ন করে না, তারাই পরজন্মে হিজড়া হয়। একারণে হিন্দু সমাজে হিজড়াদেরকে ধর্মীয়ভাবে সেই মূল্যায়ন করা হয় না। তবে হিন্দুদের অনেকে হিজড়াদের সঙ্গে ভালো আচরণও করে।

 

হিন্দুদের বিশেষ এক জাতের নাম আরাবানী। তাদের ধর্ম বিশ্বাস উপরে বর্ণিত হিন্দুদের ধর্ম বিশ্বাস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আরাবানী হিজড়ারা আরাবান দেবতার পূঁজা করে। অনেক মন্দিরে হিজড়াদের নাচের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক হিন্দু বিশ্বাস করে হিজড়াদের আশির্বাদ করার এবং অভিশাপ দেয়ার বিশেষ ক্ষমতা আছে। (পট্টনায়েক, দেবদূত; ২০০২, Wilhelm, Amara Das; 2003, Peopl of the third sex; 11o)।

 

খ্রিস্ট ধর্মে হিজড়া:

খ্রিস্ট ধর্মের নিউ টেস্টামেন্টে স্পষ্ট করে তৃতীয় লিঙ্গ সম্পর্কে বলা হয়েছে। বিবাহ এবং বিচ্ছেদ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রাক্কালে জেসাস বলেন, কিছু মানুষ জন্ম থেকেই ঊঁহঁপযং -এ পরিণত হয় এবং কিছু মানুষ আছে যারা স্বর্গ রাজ্যের জন্য নিজেদের weevn-এ রূপান্তরিত করে। কিছু খ্রিস্টান সংঘ হিজড়াদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ইউনিটারিয়ান একটি ধর্মমত। এটি তাদের মূল খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে তারা সর্বপ্রথম হিজড়াদের পূর্ণ সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইউনিটারিয়ান ইউনিভার্সালিস্ট এসোসিয়েশন প্রথম একজন হিজড়া ব্যক্তিকে মনোনীত করে। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে চার্চ অব খ্রিস্ট সকল হিজড়া ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার মত পেশ করে। (Unitarin universalist association; 21 August 2012, 2 Maz 2014, Wenjuan, Angelina; 24 Februarz 2011)।

 

বিশ্বে তৃতীয় লিঙ্গ বা ক্লিপ লিঙ্গ হিসেবে খ্রিস্ট দুনিয়াই প্রথম প্রশ্ন তুলে। তারাই হিজড়াদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের জন্য সুযোগ সুবিধার কথা বিবেচনা করে। এর ফলশ্রুতিতে আমরিকা এবং ইউরোপে বহুদেশে সাধারণ নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে হিজড়া সম্প্রদায়। সকল সরকারি সুবিধাতে হিজড়া কোটা বরাদ্দ থাকছে। 

 

বৌদ্ধ ধর্মে হিজড়া:

অধিকাংশ বৌদ্ধ লিপিতে ধর্ম প্রতিপালনে কোনো লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন করা হয়নি। নির্বাণ লাভের জন্য কামনাকে এই শাস্ত্রে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। থাই বৌদ্ধ ধর্মে ‘কতি’ বলে একটি শব্দ আছে। মেয়েদের মত আচারণকারী পুরুষকে ‘কতি’ বলা হয়। এটা সেখানে পুরুষ সমকামীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়। থাইল্যান্ডে কতিদের বিবাহের অনুমতি নেই। তারা কখনো বিয়ে করতে পারবে না। থাইল্যান্ডে কতিদের নারীতে রূপান্তরিত হওয়া কিংবা পুরুষের সঙ্গে বিবাহ দেয়া এখানো আইনত অবৈধ। কিন্তু হিজড়া নারীরা তাদের ইউরোপীয় সঙ্গীকে বিয়ে করতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে তাকে থাইল্যান্ড ত্যাগ করে তাদের সঙ্গীদের দেশে চলে যেতে হবে। (Homo sexualitz in Buddhism, Matzner, Andrew; 2000) কোনো হিজড়া নিজেকে থাই পরিচয় দিতে রাজি হয় একারণে যে, থাই সমাজে হিজড়ার ভিন্ন শ্রেণি নেই। আমাদের বাংলাদেশে যেমন তাদের জন্য ভিন্ন একটি সমাজ রয়েছে। থাইতে এমনটি নেই। একারণে থাইল্যান্ডে হিজড়াদেরকে ব্যবহার করা হয় আচ্ছাতালে তবে তাদেরকে ভিন্ন মর্যাদা প্রদান করা হয় না। বৌদ্ধধর্মে যদিও তাদের লিঙ্গ বিভাজন করেনি, ভারত নেপাল ভুটান ও মালদীপে প্রচুর পরিমাণ বৌদ্ধ হিজড়া রয়েছে। যারা পর্যটন হোটেলগুলোতে কাজ করে। 

 

ইহুদী ধর্মে হিজড়া:

ইহুদী ধর্মে হিজড়াদের ‘সারিস’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হিব্রু ‘সারিস’ ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে Chamberlain অথবা mvwim নামে। তনখ -এ সারিস শব্দটি ৪৫বার পাওয়া যায়। সারিস বলতে একজন লিঙ্গ নিরপেক্ষ বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে বোঝায় যিনি শক্তিমানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ঈশ্বর সারিসদের কাছে এই বলে প্রতিজ্ঞা করেছে, তারা যদি সাবাথ পালন করে এবং রোজা রাখে তাহলে তাদের জন্য স্বর্গে একটি উত্তম মনুমেন্ট তৈরি করবেন।

তোরাহ’য় ক্রস ড্রেসিং (পুরুষ কর্তৃক নারীর মতো পোশাক পরা) এবং জেনিটাল বা শুক্রাশয় ক্ষতিগ্রস্থ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে। আর সেজন্য অনেক ইহুদী হিজড়াদেরকে ধর্ম বহির্ভুত মানুষ মনে করে। কারণ তার বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান করে। K‡i| (Born Eunuche librerz, টেমপ্লেট, Biberef)

 

ইসলাম ধর্মে হিজড়া:

শান্তি এবং মানবতার ধর্ম, সাম্য আর উদারতার ধর্ম ইসলাম। স্নেহ-মমতা, সহনশীলতা, সহমর্মীতা আর উত্তম চরিত্রের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ইসলাম। ব্যক্তি পরিসর থেকে শুরু করে পরিবার-পরিমণ্ডল সমাজ এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা তথা সর্বক্ষেত্রে মানুষের প্রকৃত অধিকার নিশ্চিত করেছে ইসলাম। মানবতার মুক্তির একমাত্র পথ ও সঠিক দিশা শাশ্বত ধর্ম ইসলাম। আসুন খুঁজে দেখি তৃতীয় লিঙ্গ (Trans gender) সম্পর্কে ইসলাম ধর্ম কি বলে।

 

ইসলাম ধর্মে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে কোনো সাপোর্ট নেই। তবে হ্যাঁ, হিজড়াদের নিয়ে ইসলাম ধর্মে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। রয়েছে তার সম্পৃর্কিত বিধিবিধান। আমরা আগেই জেনেছি হিজড়া তিন শ্রেণির। প্রথম শ্রেণি পুরুষ হিজড়া। তাদের শরিয়ত পালনের সকল হুকুম আহকাম একজন সুস্থ পুরুষের হুকুম আহকামের মতো। সাধারণ পুরুষগণ যেভাবে শরিয়ত পালন করেন ইবাদত আমল আখলাক গঠন করেন পুরুষ হিজড়াও সেইভাবে করবে। দ্বিতীয় প্রকার হিজড়া হলো নারী হিজড়া। তাদের শরিয়ত পালনের সকল হুকুম আহকাম একজন সুস্থ নারীর হুকুম আহকামের মতো। সাধারণ নারীগণ যেভাবে শরিয়ত পালন করেন ঈমান আমল ইবাদত পর্দাপুশিদা আখলাক গঠন করেন নারী হিজড়াও সেইভাবে করবে। তৃতীয় শ্রেণির হিজড়া যারা প্রকৃত অর্থে হিজড়া। এই তৃতীয় শ্রেণির হিজড়াকেই ইসলাম হিজড়া বলে। আর অন্য দুই প্রকারকে ইসলাম হিজড়া বলে স্বীকৃতি দেয় না। আলরাহরুর রায়েক ৯/৩৬ কিতাবের বর্ণনা মতে এই তৃতীয় শ্রেণির হিজড়াদের পর্দা করতে হবে এবং নারীদের মতোই তার পর্দার বিধান মেনে চলতে হবে। সাধারণ নারীদের মতো হবে তাদের চলাফেরা। তাদের হজ ও সফরে গাইরে মাহরাম থাকতে হবে। তার একাকি সফর করতে পারবে না। সাক্ষীর ক্ষেত্রের তার একজন পুরুষের অর্ধেক কাজে দেবে। তারা ইমামতি করতে পারবে না, তারা বিচারক হতে পারবে না।

 

আলমউসুআতুল ফিকহিয়্যা আলকুওয়াইতিয়্যাহ এর ২০খণ্ডে ২২পৃষ্ঠায় রয়েছে এমন হিজড়াদের জন্য পুরুষের বা তার মতো হিজড়াদের ইমামতি করা জায়েজ নেই। তবে শুধু নারীদের ইমাম হওয়ার সুযোগ আছে। তবে মাকরুহ হওয়ার কথা জানিয়েছেন ওলামায়েকেরাম। একারণে তার একেবারে ইমামতি না করা-ই উত্তম। জামাতে নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে তারা কোথায় দাঁড়াবে? তারা পুরুষের পেছনে দাঁড়াবে না। সামনে দাঁড়ালে উভয়ের নামাজ বাতিল বলে গন্য হবে। তবে বসার ক্ষেত্রে সাধারণ নারীদের মতো করে বসবে। 

 

আলরাহরুর রায়েক ৯/৩৩৬ এর বর্ণনা মতে তাদের জন্য সবধরণের অলঙ্কার পরিধান করা মাকরুহ। কারণ পুরুষের জন্য অলঙ্কার পরিধান করা হারাম আর নারীদের বেলায় মুবাহ। আর যেহেতু তার মধ্যে পুরুষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাই অলঙ্কার পরিধান করা মাকরুহ। (বাদায়ে সানাইয়ে ৭/৩২৯) এই শ্রেণি হিজড়াদের খতনা করাতে হবে। (আলমউসুআতুল ফিকহিয়্যা আলকুওয়াইতিয়্যাহ ২০/৩০)

 

ইসলাম ধর্মেই হিজড়াকে সঠিক মূল্যায়ণ করা হয়েছে। ইয়াহুদি বৌদ্ধসহ অনেক ধর্মেই হিজড়াদেরকে দেয়া হয় না কোনো সামাজিক মর্যাদা, করা হয় না বাছবিচার। এর এসব কারণেই হিজড়া সমাজ নিজেদের ভিন গ্রহের প্রাণী ভাবতে থাকে। যার শেষ পরিণত হয় কোনো দুর্ঘটনা। সমাজ বহির্ভূত কাজে হিজড়াসমাজ জড়িয়ে যায়। তাই আমাদের ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ঠ্র সর্বমহলের কর্তব্য হলো- হিজড়াদেরকে সঠিক পরিচর্যা করা। তারাও আমাদের মতো মানুষ আমাদের মতো সাধারণ চলাফেরার অধিকার রাখে। 

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল