• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

সাউথ আমেরিকান যাদু-বাস্তবতার গল্প

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২১ নভেম্বর ২০১৯  

দক্ষিণ আমেরিকার ইসাবেল আলেন্দের ‘উয়ালিমাই’ গল্পের ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ। লেখক গল্পটিকে মনোমুগ্ধকরভাবে উপস্থাপন করেছেন। অনুবাদটির স্বত্ব সংরক্ষিত।)

 

উয়ালিমাই। আমার পিতার দেওয়া নাম। উত্তরের মানুষদের ভাষায় এর অর্থ বায়ুপ্রবাহ। কথাগুলো আমি তোমাকে বলছি, কারণ তুমি আমার মেয়ের মত। আমাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী আমাকে তুমি এই নাম ধরে ডাকতে পার। কারণ, পরিবারের মধ্যে আমরা একে অন্যকে নাম ধরে ডেকে থাকি। 

 

আমি মনে করি মানুষ ও অন্যান্য জীবিতদের নামের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে।  কারণ নাম হল এমন কিছু, যেটার উচ্চারণ হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়। নামের মাধ্যমেই আমরা অন্যদের অন্তর্নিহিত শক্তির ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হই। নাম ডেকেই আমরা রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়দেরকে স্বাগত জানাই। 

 

আমি বুঝতে পারি না বিদেশীরা কেন মান্যতা ছাড়াই পরস্পরকে ডাকাডাকি করে থাকে। এটা শুধুমাত্র অসুন্দরই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে মারাত্মক বিপদ পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। আমি লক্ষ্য করেছি যে, তারা পরস্পরের সাথে খুবই তাচ্ছিল্যভাবে কথা বলে থাকে এবং আলাপচারিতার বিষয়ে একেবারেই যত্নশীল নয়। অথচ প্রতিটি মানুষের কথা ও অঙ্গভঙ্গি প্রকৃতপক্ষে তার চিন্তার ফসল। এটাকে অযথা ব্যয় করা উচিৎ নয়। আমার সন্তানদের আমি এটাই শিখিয়েছি। যদিও সকল সময়ে তারা আমার শিক্ষাকে মান্য করে না।

 

অতীতকালের মানুষরা প্রচলিত ট্যাবু ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলোকে শ্রদ্ধা করত। আমার দাদা, দাদার দাদা বা তাদের দাদা – সবাই নিজ নিজ পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তাদের কালে এই জ্ঞানগুলো ছিল অপরিবর্তনীয়। ফলে একজন ভাল শিক্ষা পাওয়া মানুষ পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে অর্জিত সকল জ্ঞানই যত্ন সহকারে মনে রাখত। শুধু তাই নয়, সে জানত সেগুলোকে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে। 

 

কিন্তু একসময়ে আমাদের অঞ্চলে বিদেশীরা আগমন করল। তারা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞানের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করল এবং এক সময়ে আমাদেরকে জন্মস্থান থেকে তাড়িয়ে দিল। আমরা জঙ্গলের গভীরে চলে গেলাম। কিন্তু তারা আমাদের পিছু ত্যাগ করল না। কয়েক বছর পরে পুনরায় তারা আমাদের কাছে আগমন করল। আমরা তখন বাধ্য হয়ে পুনরায় আমাদের ফসল ধ্বংস করলাম এবং সন্তানদের পিঠে নিয়ে পশুদেরকে সহ সেখান থেকে চলে গেলাম। জঙ্গলের গভীর থেকে  আরও গভীরে।  

 

এভাবেই চলছিল। যতদিন পর্যন্ত আমি স্মরণ করতে পারি। সবকিছু ফেলে দিয়ে ইঁদুরের মত আমরা দৌড়ে পালাচ্ছিলাম। বার বার। কারণ আমরা আদিকালের পুর্বপুরুষ বা ঈশ্বরগণের মত বড় যোদ্ধা ছিলাম না। এমনকি আমাদের মধ্যকার কিছু সংখ্যক যুবকেরা সাদা মানুষদের সম্পর্কে খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। ফলে আমরা যতই অরণ্যের গভীরে চলে গিয়ে পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রা অনুসরণ করে বাস করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, ততই এরা বিপরীত মুখে অভিযাত্রা করছিল। এই দল ত্যাগকারীদেরকে আমরা মৃত বলে বিবেচনা করতাম। কারণ এদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকই আমাদের কাছে ফিরে আসত। অবশিষ্টরা এতই বদলে যেত যে, আমরা তাদেরকে আত্মীয় বলে আর চিনতেই পারতাম না।   

 

আমি শুনেছি যে, আমার জন্মের পূর্বে আমাদের এলাকায় খুব কম সংখ্যক মেয়েসন্তান জন্মাত। এই কারণে আমার পিতাকে দূরদূরান্তরের অন্য উপজাতি হতে স্ত্রী আনার জন্যে গমন করতে হয়েছিল। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পূর্বপুরুষদের পথরেখা অনুসরণ করে, যারা স্ত্রী সংগ্রহ করার পর এই পথ দিয়ে ফিরে এসেছিলেন।

 

আমার পিতার গল্পটা ছিল এরকম। জঙ্গলের ভেতরে ভ্রমণ করতে করতে তার অনেকদিন অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি নিজের সঙ্গিনীকে খুঁজে পাবার সমস্ত সম্ভাবনাও উবে গিয়েছিল। ঠিক সেই সময়ে তিনি একটা মেয়েকে দেখতে পেয়েছিলে। বিশাল উঁচু একটা জলপ্রপাতের পাদদেশে। জলপ্রপাতটা আসলে ছিল একটা নদী। আকাশ থেকে পড়ছিল। মেয়েটি যাতে ভয় না পায়, সেজন্যে তিনি খুব নিকটে না গিয়ে, দূর থেকে ডাক দিয়েছিলেন। মধুর কন্ঠে। ঠিক যে কন্ঠে শিকারীরা শিকারকে আশ্বস্ত করে থাকে। এবং বিবাহের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। মেয়েটিও তাকে এগিয়ে যেতে বলেছিল এবং কপটতা ছাড়াই তাকে পর্যবেক্ষন করছিল। তবে বিয়ে বিষয়টি অত সহজ ছিল না। মেয়েটির মূল্য পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত আমার পিতাকে তার শ্বশুরের জন্যে কাজ করতে হয়েছিল। তারপর বিয়ের সমস্ত প্রথা সঠিকভাবে পালন করে দুজনে আমাদের গ্রামে চলে এসেছিলেন।

 

আমি বড় হয়েছিলাম বৃক্ষের ছায়ায়। আমার ভাইদের সাথে। সূর্যের মুখ না দেখেই। কখনও কখনও কোন গাছ অসুস্থ্য হয়ে ভেঙে পড়লে বনের গভীর গম্বুজের মধ্যে একটু ফাঁকের সৃষ্টি হত। শুধুমাত্র সেই সময়েই ফাঁক দিয়ে আমরা আকাশের নীল চোখ দেখতে পেতাম।

 

পিতামাতারা আমাদেরকে গল্প শোনাতেন। গান গাইতেন। আমাদেরকে শিখাতেন কীভাবে অন্যের সাহায্য ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব। শুধুমাত্র তীরধনুকের সাহায্য নিয়ে। এভাবেই আমরা স্বাধীন জীবন যাপন করতাম। কারণ আমরা চাঁদের সন্তানেরা, স্বাধীনতা ছাড়া বাঁচতে সক্ষম ছিলাম না। আমাদেরকে যখন দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ করা হত, তখন আমরা পৃথিবীর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতাম। অন্ধ ও কালা হয়ে যেতাম। ফলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের আত্মা শরীর ছেড়ে চলে যেত। অথবা কখনও কখনও দুঃস্থ বন্য পশুদের মত হয়ে যেতাম। তবে মরে যেতেই বেশী পছন্দ করতাম।

 

আমাদের বাসস্থানগুলোতে কোন দেয়াল থাকত না। শুধুমাত্র ঢালু হয়ে আসা ছাঁদগুলো ছাড়া। এরা বায়প্রবাহকে ঠেকাত এবং বৃষ্টির জলকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিত। এই ছাঁদের নীচে পাশাপাশি   হ্যামক পেতে আমরা আমাদের নারী ও শিশুদের স্বপ্নগুলো শুনতে পছন্দ করতাম। বানর, কুকুর এবং শামুকের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসকে অনুভব করতাম। ওরাও একই ছাঁদের নীচে বাস করত, ঘুমাত। জীবনের প্রথম অংশে বনের ভেতরে অবস্থানকালে আমি কখনই জানতাম না যে, আমাদের সামনের উঁচু খাড়া পাহাড় বা নদীর ওপারে পৃথিবী বলে কিছু আছে। কোন কোন সময়ে অন্য উপজাতিগুলো থেকে অতিথি মানুষেরা আসত। তারা আমাদেরকে মরুভূমি, বিদেশী এবং তাদের সংস্কৃতির কথা বলত। আমরা কখনই সেগুলোকে সত্য মনে করতাম না। লোক হাসানোর গল্প মাত্র মনে করতাম।  

 

আমি বড় হলাম। এবং আমার জন্যেও স্ত্রী যোগাড় করার সময় চলে এল। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বিলম্ব করার। কারণ একাকী থাকতেই আমি বেশী পছন্দ করতাম এবং একাকীই সুখী অনুভব করতাম। কিন্তু অন্যদের মত খেলাধুলা এবং অবসর যাপন করায় আমি মনোনিবেশ করতে সক্ষম ছিলাম না। কারণ, আমার পরিবারটি ছিল বিশাল আকারের। অনেকগুলো ভাই, চাচাতো ভাই, ফুফাত ভাই এবং ভাতিজা-ভাগ্নেদের নিয়ে। এই বিশাল পরিবারের খাবারের সংস্থান করতে আমাকে প্রতিনিয়তই বনে যেতে হত। শিকারের জন্যে।   

 

একদিন একদল মানুষ এল। আমাদের গ্রামে। ফ্যাঁকাসে রঙের। এরা শিকার করে গানপাউডার ব্যবহার করে। দূর থেকে। যেখানে দক্ষতা বা সাহসের প্রয়োজন হয় না। এরা গাছে আরোহণ করতে পারে না। বর্শাকে জলের গভীরে গাঁথতে পারে না। গভীর জঙ্গলের ভেতরে স্বচ্ছন্দে চলাচল করতেও পারে না। শুধুই নিজেদের ব্যাকপ্যাক বা অস্ত্রের সাথে জট পাকিয়ে থাকে। সারাক্ষণ।  আমাদের মত মুক্ত বাতাসের পরিচ্ছদ পরিধান করে না। এদের গায়ের কাপড় ভেজা ও গন্ধযুক্ত। শরীরও খুবই ময়লাযুক্ত। আদবকায়দা সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ জানে না। শুধু নিজেদের জ্ঞান ও ঈশ্বর সম্পর্কে জাহির করার জন্যে উদগ্রীব হয়ে থাকে। নিজেদেরকে এরা সাদা মানুষ বলে পরিচয় দিয়েছিল। অবশ্য তাদের দাবীর সত্যতা নিয়েও আমরা সন্দিহান ছিলাম। 

 

তবে খুব তাড়াতাড়িই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, এরা মিশনারী, সৈনিক অথবা রাবার অনুসন্ধানকারী ছিল না। এরা ছিল উন্মাদ। যাদের একমাত্র কাজ ছিল ভূমি দখল করা এবং পৃথিবীর বুক থেকে বনকে উজাড় করে দেওয়া। কিছু দুষ্প্রাপ্য পাথর অনুসন্ধানেও তারা ব্যাপৃত ছিল।

 

আমরা তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করেছিলাম যে, জঙ্গলকে পিঠে করে মৃত পাখিদের মত এক স্থান থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তারা আমাদের কথা শুনতে চাইল না। তারা প্রত্যেকেই ছিল ঘূর্ণিঝড়ের বায়ুপ্রবাহের মত। স্পর্শে আসা সকল কিছুকেই ধ্বংস করতে করতে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল। চলার পথে শুধুমাত্র ধ্বংস চিহ্ন রেখে। বনের মানুষ ও পশু – সবাই তাদের উপরে চরমভাবে বিরক্ত ছিল। 

 

ভদ্রতার নিয়ম অনুযায়ী আমরা প্রথমে তাদের কথাগুলো মেনে নিয়ে তাদেরকে খুশী করার চেষ্টা করেছিলাম। কারণ তারা ছিল আমাদের অতিথি। কিন্তু কোনকিছুতেই তারা সন্তুষ্ট হবার মত প্রাণী  ছিল না। প্রতিবারেই তারা পূর্বের চেয়ে কিছু বেশী চাচ্ছিল। ফলে একসময়ে  ক্লান্ত হয়ে আমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলাম। ঐতিহ্য অনুযায়ী আমাদের সকল আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করে তাদেরকে আক্রমণ করেছিলাম। মোটেই তারা ভাল যোদ্ধা ছিল না। সহজেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল।  তাদের হাড়গুলোও ছিল খুবই নরম এবং তাদের মাথাগুলো আমাদের গদার আঘাত সহ্য করার মত শক্ত ছিল না।

 

এরপর আমরা গ্রাম ছেড়ে পূবের দিকে চলে গিয়েছিলাম। বৃক্ষশীর্ষ দিয়ে চলতে চলতে। অনেক দূরে দুর্ভেদ্য বনের গভীরে। যাতে তারা আমাদের পর্যন্ত পুনরায় পৌঁছাতে না পারে। কারণ আমরা জানতাম যে, তারা খুবই প্রতিশোধপরায়ন। নিজেদের প্রতিজনের মৃত্যুর বিপরীতে তারা আমাদের পুরো গ্রাম, এমনকি পুরো উপজাতিকেও ধ্বংস করে দিতে ইতস্ততবোধ করবে না।  শিশুদেরকেও তারা বাঁচিয়ে রাখবে না।

 

বনের গভীরে একটা দুর্গম স্থান আবিষ্কার করেছিলাম আমাদের পরবর্তী গ্রাম হিসেবে। যদিও বসবাসের জন্যে জায়গাটা ভাল ছিল না। আমাদের মেয়েদেরকে অনেক দূরে যেতে হত জল সংগ্রহের জন্যে। তারপরেও আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেখানে অবস্থান করার। কারণ আমাদের ধারণা ছিল যে, এতদূরে কেউ আমাদেরকে অনুসন্ধান করতে আসবে না।

 

বছরখানেক পর আমি একটা চিতাবাঘের পায়ের ছাপকে অনুসরণ করতে করতে গ্রাম থেকে অনেক দূরে চলে এসেছিলাম। একদল বিদেশী সৈনিকের ক্যাম্পের সন্নিকটে। খুবই পরিশ্রান্ত এবং কয়েকদিনের অনাহারী থাকার কারণে আমার বোধশক্তি সঠিকভাবে কাজ করছিল না। ফলে  বিদেশী সৈনিকদের উপস্থিতি বুঝতে পারার পরেও না পালিয়ে গিয়ে শুয়ে ছিলাম। সৈনিকেরা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আমাকে তারা কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। হতে পারে যে, তারা ইতিপূর্বে আমার মত কাউকে দেখেনি। অথবা আমার পূর্বপরিচয় সম্পর্কেও তারা অবহিত ছিল না।  

 

আমাকে তারা রাবার তৈরীর শ্রমিকদের সাথে কাজ করার জন্যে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমি অন্য উপজাতি থেকে আগত পুরুষদেরকেও দেখতে পেয়েছিলাম। সবাই প্যান্ট পরেছিল। তাদেরকেও ইচ্ছের বিরুদ্ধে সেখানে আনা হয়েছিল। রাবার উৎপাদন করতে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এই শ্রমিক জোগাড় করা সহজসাধ্য ছিল না।

 

আমার জীবনের এই সময়টা ছিল একটা স্বাধীনতাহীন পর্যায়। এটা নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। কিন্তু আমি সেখানে থেকে গিয়েছিলাম ভিন্ন কারণে। নতুন কিছু শেখার জন্যে। তবে শুরু থেকেই আমি জানতাম যে, আমি ফিরে যাব একসময়ে। একজন যোদ্ধাকে কেউ ইচ্ছের বিরুদ্ধে বেশী সময় ধরে আটকে রাখতে পারে না। 

 

তার উপজাতির নাম ছিল ইলা। অর্থ মিষ্টি হৃদয়ের মানুষেরা। এই উপজাতি হতেই সবচেয়ে কোমল মেয়েরা আগমন করত। কিছু কিছু পুরুষেরা মাসের পর মাস হাঁটত শুধুমাত্র ইলা উপজাতির কাছে পৌঁছানোর জন্যে। তারা উপজাতির মানুষদের জন্যে উপহার বয়ে নিয়ে আসত।  এবং তাদের জন্যে শিকার করত। শুধুমাত্র এই আশায় যে, একদিন তাদের কোন মেয়েকে  তারা পাবে। সঙ্গিনী হিসেবে। 

 

প্রথম দর্শনে তাকে সরীসৃপের মত লাগছিল। তা স্বত্বেও আমি তাকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কারণ আমার মাতাও ইলা গোত্রের ছিলেন। একটা মাদুরের উপরে সে উলঙ্গ অবস্থায় শুয়ে ছিল। তার দুই পায়ের কব্জি চেইন দিয়ে মেঝের সঙ্গে বাঁধা ছিল। অবসন্নভাবে শুয়েছিল সে। মনে হচ্ছিল নাক দিয়ে একাশিয়া বৃক্ষের ঘ্রাণ গ্রহণ করে বুঁদ  হয়ে আছে। শরীর থেকে অসুস্থ্য কুকুরের গন্ধ ভেসে আসছিল এবং তা ছিল ভেজা। আমার পুর্বে যারা তার উপরে উপগত হয়েছিল, তাদের দেহ নিঃসৃত শিশির দিয়ে।

 

তার শরীরের আকার ছিল সল্প বয়সী বালকের মত। তার হাড়গুলো নদীর তলার নুড়ি পাথরের মত শব্দ করছিল। সাধারণত মেয়েরা শরীরের সকল লোম তুলে ফেলে। চোখের পাপড়িসহ। কানদুটোকে ফুল আর পালক দিয়ে সাজায়। গালে ও নাকে মসৃণ কাঁঠি ঝুলায়। সমস্ত শরীরে ‘অনতো’, পাম গাছের গোলাপী রঙ এবং কয়লা দিয়ে রঙিন ছবি আঁকে। কিন্তু তার শরীরে এগুলোর কিছুই ছিল না।

 

আমি বর্শাটাকে মেঝের উপরে রাখলাম। অতঃপর একটা পাখির কূজন ও নদীর স্রোতের গর্জনকে  অনুকরণ করে তাকে সম্ভাষণ জানালাম। বোন হিসেবে। সে কোন উত্তর করল না। আমি তার বুকে চাপ দিলাম। বোঝার জন্যে যে, তার বুকের পাঁজরের ভেতরে কোন আত্মা অনুরণিত হচ্ছে কিনা। কিন্তু সেখানে কোন প্রতিধ্বনি ছিল না। কারণ তার আত্মা ছিল খুবই দুর্বল এবং প্রতিউত্তর দিতে অক্ষম।

 

আমি তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলাম। তাকে জলপান করালাম। এবং আমার মায়ের ভাষায় তার সাথে কথা বললাম। সে চোখ খুলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। আমি তার মনের ভাষা বুঝতে পারলাম।                 

আমার কাছে পরিষ্কার জল খুবই কম ছিল। কাজেই মুখের ভেতরে জল ভর্তি করে কুলির মত করে সরু রেখায় আমার হাতের তালুর উপরে জল ফেললাম এবং দুই হাতের তালু পরস্পরের সাথে ঘষে ভিজিয়ে নিলাম। ভেজা তালু দিয়ে নিজের মুখ মুছলাম। একই ভাবে তার মুখও মুছলাম। এবং তার শরীর থেকে উপগত মানুষদের শিশিরগুলো মুছে ফেললাম।

 

রাবার শ্রমিকদের সর্দার আমাকে প্যান্টটা দিয়েছিল পরতে। আমি সেটা খুলে ফেললাম। তারপর  কোমরের রশিতে একে একে নীচের জিনিসগুলো ঝুলিয়ে দিলাম - আগুণ তৈরী করার কাঠি, কয়েকটা ধনুক, আমার তামাকের কুণ্ডলী, একটা কাঠের ছোরা (যার প্রান্তদেশে ইঁদুরের দাঁত লাগানো ছিল) এবং একটা শক্ত চামড়ার থলে (যেটার ভেতরে আমি কিছু বিষ সংরক্ষণ করতাম)। ছুরির প্রান্তদেশে একটু পেস্ট মেখে  হামাগুড়ি দিলাম এবং তার ঘাড়ের থেকে একটু চামড়া কাটলাম।  

 

জীবন হল ঈশ্বর থেকে পাওয়া উপহার। একজন শিকারী শিকার করে থাকে পরিবারের সদস্যদের জন্যে। যাতে তারা আহার করে জীবন ধারণ করতে পারে। শিকারী কখনই বাধ্য না হলে নিজের শিকার করা পশুর মাংশ আহার করে না। সে আহার করে থাকে অন্য শিকারীদের দেয়া মাংশ। দুর্ভাগ্যক্রমে যুদ্ধের সময়ে এক মানুষ অন্য মানুষকে হত্যা করে থাকে। কিন্তু নারী বা শিশুদেরকে  হত্যা করার অধিকার ঈশ্বর কাউকে দেননি।    

 

বড় বড় চোখ দিয়ে সে আমার দিকে তাকাল। মধুর রঙের মত হলুদ চোখ। আমার মনে হল সে চেষ্টা করল হাসতে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্যে। কারণ, তার জন্যে আমি চাঁদের শিশুদের প্রথম ট্যাবুটি অমান্য করেছি। একারণে জীবনে অনেক প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে আমাকে।

 

আমি তার মুখের খুব কাছে নিজের কানকে স্থাপন করলাম। সে বিড়বিড় করে তার নাম উচ্চারণ করল। আমি নিশ্চিত হবার জন্যে দুইবার সেটা উচ্চারণ করলাম। তবে উচ্চস্বরে নয়। নিঃশব্দভাবে। কারণ মৃতদের নাম সশব্দে উচ্চারণ করতে মানা আছে। এতে তাদের শান্তি নষ্ট হয়। আমি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছিলাম যে, সে মৃত। যদিও তার হৃদয়ের স্পন্দন তখনও সম্পূর্ণভাবে থেমে যায়নি। তবুও তার পাকস্থলীর মাংশপেশী, বুক এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো – সবই অবশ হয়ে গেছে। শরীরের রঙ বদলে গিয়েছে। শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে তার শরীর মৃত্যুবরণ করেছে। মৃত্যুর সাথে কোন ধরণের যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া ছাড়াই।  যেমন করে পৃথিবীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীরা মরে যায়। 

 

অকস্মাৎ অনুভব করলাম যে, তার আত্মা নাক দিয়ে বের হয়ে এসে ক্রমশ আমার শরীরের ভেতরে প্রবেশ করছে। এবং আমার মেরুদন্ডের হাড় বেয়ে নামছে। তার অদৃশ্য শরীরের ওজন আমি অনুভব করছি। আমার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। বিশ্রীভাবে আমি এপাশ-ওপাশ করছি। যেমন করে সাঁতার না জানা মানুষেরা জলের নীচে তলিয়ে যাবার পর করে থাকে।    

 

অবশেষে শেষ শয়নের ভঙ্গীতে তার শরীরকে স্থাপন করলাম, যাতে হাঁটু চিবুককে স্পর্শ করে। তারপর মাদুরের রশি দিয়ে তাকে বাঁধলাম। অবশিষ্ট খড়গুলো দিয়ে একটা স্তুপ তৈরী করলাম। এবং কাঠিগুলো ব্যবহার করে তাতে আগুণ জ্বালিয়ে দিলাম। নিশ্চিত হলাম যে, আগুন আর নিভবে না। তারপর কুঁড়েঘরটি থেকে বেরিয়ে এলাম।

 

খুব কষ্ট করে ক্যাম্পের প্রাচীরের  উপরে উঠলাম। কারণ তার আত্মার ভর আমাকে নীচের দিকে ক্রমাগত টেনে নামাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে বনের ভেতরে প্রবেশ করলাম। বনের প্রথম বৃক্ষের কাছে পৌঁছুতেই ক্যাম্পের ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেল।    

প্রথমদিন বিরতিহীনভাবে হাঁটলাম। মূহূর্তের জন্যেও না থেমে। দ্বিতীয় দিনে একটা তীর ও ধনুক তৈরী করলাম। তার এবং আমার নিজের জন্যে শিকার করলাম।

 

একজন যোদ্ধা যখন অন্য একজন মানুষের আত্মাকে বহন করে, তখন তাকে টানা দশদিন উপোষ করতে হয়। ফলে বহনকৃত মৃত ব্যক্তির আত্মা দুর্বল হয়ে পড়ে ও নিজেকে বিযুক্ত করে। অতঃপর   আত্মাদের জন্যে নির্ধারিত স্থানে চলে যায়। কিন্তু যোদ্ধা যদি সে উপোষ না করে, তবে খাবার গ্রহণ করার কারণে আত্মা ক্রমশ স্থুল বং বহনকারী ব্যক্তির শরীরের ভেতরে বড় হতে থাকে। ফলে  এক সময়ে বহনকারী ব্যক্তির মৃত্যু হয়। শ্বাস বন্ধ হয়ে। আমি অনেক সাহসী লোককে এভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হতে দেখেছি। 

 

তবে কাজগুলো করার পূর্বে মেয়েটির আত্মাকে গহীন অন্ধকার বনের ভেতরে বয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাকে। যেখানে কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। কোনদিন। আমি কম খাওয়া শুরু করলাম। তবে এতটা  কম নয় যে, খাবারের অভাবে তাকে দ্বিতীয়বার মৃত্যুবরণ করতে হয়। যদিও যে কোন খাদ্যই আমার কাছে বিস্বাদ লাগছিল। প্রতি  কামড়েই মনে হচ্ছিল পচা মাংশ খাচ্ছি। এমনকি প্রতিবিন্দু জলকেও মনে হচ্ছিল তিক্ত। কিন্তু আমি নিজেকে বাধ্য করছিলাম গিলতে। যাতে আমাদের দুজনেরই পুষ্টি হয়। 

 

পরবর্তী অমাবস্যার রাতে আমি জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করলাম। মেয়েটির আত্মা সহ। প্রতিদিনই তার ওজন বাড়ছিল। আমরা প্রচুর কথা বলছিলাম পরস্পরের সাথে। ইলা উপজাতির ভাষায়। এই ভাষা খুবই মুক্ত  ও মধুর ধরণের। জঙ্গলের গাছের নীচে এই ভাষা অনুরণন তোলে। ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। গান, শরীরের অঙ্গভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি, কোমরের সঞ্চালন এবং পা ব্যবহার করে আমরা পরস্পরের সাথে ভাব বিনিময় করছিলাম।

 

আমি তাকে আমার পিতা ও মায়ের কাছ থেকে শোনা পুরাণের গল্পগুলো শোনালাম। আমার অতীত সম্পর্কে তাকে বললাম। সেও আমাকে তার শৈশবের গল্প শোনালো। কীভাবে সে তার ভাইদের সাথে কাদামাটির ভেতরে শুয়ে শুয়ে গড়াত এবং গাছের উঁচু ডাল থেকে দোলনায় ঝুলত।  শুধুমাত্র তার শেষ দুর্দশা ও অপদস্ত হবার গল্প ছাড়া সবই সে আমাকে বলেছিল।

 

আমি একটা সাদা পাখি ধরলাম। পাখির শরীর থেকে সবচেয়ে সুন্দর পালকগুলো খুলে নিলাম।  এবং তার কানের জন্যে অলংকার তৈরী করলাম।  রাতের বেলায় আমরা একটা ক্ষুদ্র আলো জ্বালিয়ে রাখতাম। যাতে সে শীতল হয়ে না যায়। এবং তার স্বপ্নের ভেতরে চিতাবাঘ ও সাপেরা উপদ্রব না করে। আমি খুব সতর্কতার সাথে নদীর জলে তাকে স্নান করাতাম। ছাই দিয়ে তার শরীর পরিষ্কার করে দিতাম। ফুলের পাপড়ি তার শরীরে ঘষে দিতাম। যাতে তার খারাপ স্মৃতিগুলো দূর হয়ে যায়। 

 

অবশেষে একদিন আমরা সঠিক জায়গাটিতে এসে পৌঁছলাম। এরপর আমাদের আর হাঁটার প্রয়োজন ছিল না। এই জায়গাটা গভীর ঘন বন। এখানকার জঙ্গল এতই ঘন ছিল যে, ছুরি বা দাঁত দিয়ে গাছের শাখা-প্রশাখা কেটে কেটে এখান পর্যন্ত আমাদেরকে আসতে হয়েছিল। খুবই নিম্নস্বরে কথা বলছিলাম আমরা। যাতে সময়ের নীরবতা ভঙ্গ না হয়।

 

একটা জলাধারের পাশে গাছের পাতা দিয়ে আমি একটা ছাঁদ তৈরী করলাম। নীচে তার জন্যে একটা হ্যামক টাঙালাম। তিনটা দীর্ঘ ডাল দিয়ে। ছুরি দিয়ে নিজের মাথামুন্ডন করলাম। এবং উপবাস শুরু করলাম।

 

হাঁটার সময়ে আমরা পরস্পরকে এতই ভালবেসেছিলাম যে, আর কখনই নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু অন্যের জীবনের মালিক মানুষ নয়। এমনকি নিজের জীবনেরও নয়।   সুতরাং আমাকে আমার দায়িত্ব সম্পূর্ণ করতে হয়েছিল। অনেক দিন আমি মুখে কোন খাবারই গ্রহণ করিনি। শুধু মাত্র কয়েক বিন্দু জল ছাড়া। আমার শক্তি কমে যাওয়ার সাথে, ক্রমেই সে আমার আলিঙ্গন থেকে খসে পড়তে লাগল। এবং তার স্বর্গীয় আত্মা হালকা হতে লাগল। 

 

পাঁচ দিন পর। আমি যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম, তখন সে বাইরের দিকে প্রথম পা ফেলল। কিন্তু আমি তাকে একাকী ভ্রমণ করতে দিতে রাজী ছিলাম না। সুতরাং সে ফিরে এসে পুনরায় আমার পাশে এসে বসল। এভাবে পর পর কয়েকবার সে তার যাত্রা শুরু করল। প্রতিবারেই পূর্বের চেয়ে বেশী দূরত্ব অতিক্রম করল। তার চলে যাওয়ার বেদনা আমার কাছে খুবই তীব্র কষ্টের ছিল। তবুও আমি সকল সাহস সঞ্চয় করে তাকে উচ্চস্বরে ডাকা থেকে বিরত থাকলাম। এটা আমি আমার পিতার কাছ থেকে শিখেছিলাম।

 

দ্বাদশ দিনে আমি স্বপ্ন দেখলাম যে, সে  টৌক্যান ( মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দীর্ঘচঞ্চু পক্ষিবিশেষ) পাখির মত গাছের মাথার উপর দিয়ে উড়ছে। ঘুম থেকে জাগার পর নিজেকে খুবই হালকা মনে হল এবং ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে হল। সে আমাকে ত্যাগ করে চলে গেছে। সন্দেহাতীতভাবে। 

 

আমি অস্ত্র নিয়ে নিরুদিষ্টভাবে হাঁটতে শুরু করলাম। একসময়ে একটা নদীর বাঁকে পৌঁছলাম। কোমর জলে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলাম। অনেকক্ষণ। কোঁচ দিয়ে একটা মাছ শিকার করলাম।  সেটাকে ভক্ষণ করলাম। পুরোটাই, আঁশ ও লেজ সহ। পরক্ষণেই সেটাকে বমি করে ফেলে দিলাম। একটু রক্ত সহ। এটাই নিয়ম।

 

দুঃখের আর কোন অনুভূতি আমার ভেতরে রইল না। সেই সময়েই আমি শিখলাম যে, কখনও কখনও মৃত্যু ভালবাসার চেয়ে শক্তিশালী হয়।  

 

জল থেকে ঊঠার পর আমি শিকার করতে বেরুলাম। যাতে খালি হাতে আমাকে গ্রামে ফিরতে না হয়।  

(অনুবাদের স্বত্ব সংরক্ষিত থাকবে) 

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল