• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

সহকর্মীকে ধর্ষণ : সাবেক ভিপি নূরসহ অপরাধীদের গুমর ফাঁস

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০  

নিজেদের ‘নিষ্পাপ’ দাবি করে উল্টো সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও এবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের শীর্ষ নেতাদের গুমর ফাঁস করে দিলেন সহযোদ্ধারাই। তারা নিজ সংগঠনের নারী সহকর্মীকে ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরসহ ছয় শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা তুলে ধরে বিচারেরর দাবি তুলেছেন। অপরাধীদের গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন ভুক্তভোগী ছাত্রীর সহপাঠীরা। এদিকে মামলার প্রধান আসামি ও সংগঠনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন গ্রেফতার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছেন।

গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর এক ছাত্রী সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনকে প্রধান আসামি করে নুরুল হক নূরসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। হাসান আল মামুন ওই ছাত্রীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করেছেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। মামলায় অন্য আসামিরা হলেন দুই যুগ্ম আহ্বায়ক নাজমুল হাসান সোহাগ এবং সাইফুল ইসলাম, ঢাবি শাখার সহ-সভাপতি নাজমুল হুদা ও কর্মী ঢাবি শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ হিল বাকি।

এরপর সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ওই ছয়জনকেই আসামি করা হয়। দ্বিতীয় মামলায় পরস্পর যোগসাজশে অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্ষণে সহযোগিতা এবং হেয়প্রতিপন্ন করতে ডিজিটাল মাধ্যমে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। কোতোয়ালি থানার ওসি মিজানুর রহমান জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছয়জনকে আসামি করে মামলাটি দায়ের হয়েছে। মামলায় চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে আটটার দিকে কোতোয়ালি থানাধীন সদরঘাট হোটেল এ্যান্ড রেস্টুরেন্টে ওই তরুণীকে ধর্ষণ করার অভিযোগ করা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।

এদিকে মামলার পরপরই একে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দাবি করে বিক্ষোভ মিছিল ভাংচুর শুরু করে নুরুল হক নূরসহ সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী। তারা একে সরকারের ষড়যন্ত্র অভিহিত করে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তোলেন। মামলা না তুললে সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর হুমকিও দেন শাহবাগে সমাবেশ করে। এমনকি মামলা দায়ের করা ছাত্রীকে ছাত্রলীগের কর্মী বলেও প্রচার করা হয়।

নূরসহ অন্যরা প্রথমে দাবি করেন, ‘মামলা দায়ের করা ছাত্রীকে তারা কোনদিন দেখেননি।’ পরে নূর বলেন, ‘তাকে একদিন দেখেছেন।’ বিষয়টি নিয়ে এমন নানা রকম তথ্য দেয়ার মধ্যেই এবার বেড়িয়ে এসেছে নিজ সংগঠনের প্রতিবাদী নেতাদের বক্তব্য থেকেই। ভুক্তভোগী ছাত্রী নিজ সংগঠনের সক্রিয় ও প্রথম সারির কর্মী জানিয়ে একে একে সব তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন প্রতিবাদী নেতারা।

সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি জানিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সংগঠনের এক যুগ্ম আহ্বায়ক এপিএম সোহেল বলেছেন, ‘অভিযোগকারী মেয়েটি ছাত্রলীগ বা অন্য কোন রাজনৈতিক সংগঠনের নয়। সে আমাদের ছাত্র অধিকার পরিষদেরই একনিষ্ঠ একজন শুভাকাক্সক্ষী।’ নিজ সংগঠনের নেতাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ‘এই মেয়েটা সমাধানের জন্য তোমাদের কাছে কান্নাকাটি করে নাই? তোমরা তাকে আদালতে যাওয়ার হুঙ্কার দিয়েছিল এই ভেবে যে, সহজ সরল মেয়ে হয়ত আদালতে যাবে না আর বিষয়টা সামনে আসলেও জনপ্রিয়তা দিয়ে ঢেকে দিবা।’

সোহেল জনকণ্ঠকে বলেন, অভিযোগকারী মেয়েটিকেই বাজেভাবে উপস্থাপন করছে, রাজনৈতিক রং লাগাচ্ছে। তাই এসব বিষয়ে কথা বলি। মেয়েটি তার সঙ্গে যা ঘটেছে সেটি আমাদেরকে জানিয়েছিল। পরে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথাও বলেছি। তখন হাসান আল মামুন বার বার বলেছে, অভিযোগ থাকলে আদালতে যেতে, সে সব সময় অস্বীকার করে আসছে। সবকিছু জানার পর আমাদের মনে হয়েছে বিষয়গুলো সত্য। এছাড়া সবাই জানে যে, হাসান আল মামুনের সঙ্গে ওই মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সংগঠনের কেউ প্রতিপক্ষের দ্বারা হামলার স্বীকার হলে মেয়েটি রান্না করে নিয়ে যেত। এসব বিষয় সংগঠনের সবার কাছে জানা।

সংগঠন ভিন্ন পথে চলে যাচ্ছে অনেকে এই ঘটনার বিচার চাইছে। এখানে মেয়েটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার কিছু নেই। আমরাই যখন উদ্যোগ নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করছি, তখন আমাদেরকেই ষড়যন্ত্রকারী বলে উল্লেখ করছে।

এপিএম সোহেল বলেন, অভিযোগকারী শুরুতেই যখন শুধু সংগঠনের ঢাবি অধ্যয়নরত কয়েকজনকে নিয়ে সমাধানে বসেছিল, সেখানে থাকে হুমকি বা অপমান না করলে সেই মেয়ে ঢাবির বাইরে গিয়ে আমাদের কাউকে জানাইত না। সমাধান করলে বিষয়টা এতদূর আসত না। যখন ঢাবির নেতাকর্মীদের কাছে বিচার না পেয়ে উল্টো হয়রানির শিকার হয়, তখন সে ঢাবির বাইরে আমরা যারা সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ছিলাম, জুন জুলাইয়ের দিকে আমাদেরকে জানায়। আমরা মেসেঞ্জারের চ্যাটগ্রুপ খুলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলে নুরুল হক নূর, হাসান আল মামুন ও সাইফুলসহ অন্যরা আমাদেরকে ষড়যন্ত্রকারী বলে আখ্যা দেয়।

খুলনার ছাত্র অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক মোঃ আমিনুর রহমান সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের উদ্দেশ করে লিখেছেন, শোনো ভাইয়ারা (ফেসবুক) গ্রুপ এখনও দুইটা এক্টিভ আছে। যার একটার এ্যাডমিন আমি আছি যেখানে হাসান আল মামুন আর নাজমুল হাসান সোহাগকে নিয়ে বিচার বসানো হয়েছিল। যেখানে হাসান আল মামুন ভুক্তভোগীকে আদালতে যেতে বলেছে। তিনি প্রশ্ন করেন, আজ সেই হাসান আল মামুন পলাতক কেন? নিজেই বলছে আদালতে যেতে এখন নিজেই উধাও। প্রমাণ করে দাও যে, মামলা মিথ্যা, আমরাও চাই মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হোক।

তবে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক মোঃ মশিউর রহমান দাবি করেছেন, এপিএম সোহেলের সঙ্গে সংগঠনের এখন কোন প্রকার সাংগঠিনক সম্পর্ক নেই। সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে এবং নৈতিক পদস্খলনজনিত কারণে গত ৬ মাস আগেই সাংগঠনিকভাবে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া অনেকে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। আমরা সেটা বুঝতে পারার পরেই তাদের সাংগঠনিক সম্পর্ক ছিন্ন করি। তারাই এখন সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে কুৎসা রটনা করে আসছে।

এদিকে এই ঘটনা ছাত্র রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব তৈরির পেছনে বড় বাধা হিসেবে মনে করছেন অনেক ছাত্র নেতা। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সাবেক সদস্য তানভীর হাসান সৈকত বলেন, বর্তমানে মেয়েরা এমনই রাজনীতি বিমুখ। সে ক্ষেত্রে যে সংগঠনই হোক, ভিপি নূর’র কাছে অভিযোগ আসার পর তার উচিত ছিল, বিষয়টা সমাধান করে মেয়েটির পাশে দাঁড়ানো এবং হাসান আল মামুনের ব্যাপারে সাংগঠিনক ব্যবস্থা করা। তিনি সেটি না করে ওই মেয়েকে হুমকি দিয়েছে, যেটি ভিপি হিসেবে উচিত হয়নি। সাংগঠনিক এখন পর্যন্ত কোন বিবৃতি পর্যন্ত দেয়নি যেখানে বিষয়টা তারা অস্বীকার করেছে। তাদের সংগঠনের একটা অংশ কিন্তু এই ঘটনা সত্য বলেই জানাচ্ছে।

ধর্ষণের বিচার দাবিতে মানববন্ধন ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন এবং ডাকসুর সদ্য সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরসহ অভিযুক্তদের বিচার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন করেছে ভুক্তভোগীর সতীর্থবৃন্দ। মানববন্ধনে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চতুর্থ বিভাগের শিক্ষার্থী আনোয়ারুল কবির দিপু, আব্দুর রহমান, সালাউদ্দীন আহমেদসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী অংশ নেন।

এ সময় বিচারপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের বিরুদ্ধে না। আমাদের আন্দোলন ধর্ষকের বিরুদ্ধে। ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তারা বলেন, আপনারা ধর্ষিতার বিচার পাওয়ার সহযোগিতা না করে বরং ধর্ষকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আপনারা একজন ধর্ষকের পক্ষ হয়ে আন্দোলন করছেন এটা মোটেও শোভনীয় নয়।

লাপাত্তা মামুন, সংগঠন থেকে বহিষ্কার ॥ এদিকে মামলা হওয়ার পর থেকে লাপাত্তা হয়েছেন সংগঠনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন। গত কয়েকদিনে তাকে ক্যাম্পাস ও সংগঠনের কোন কর্মসূচীতে দেখা যায়নি। ফোনও বন্ধ। অন্য নেতাকর্মীরাও তার খবর জানেন না বলে দাবি করছেন। তবে হাসান আল মামুনসহ চার নেতার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা নিরূপণে এবং সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে তিনজনকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সংগঠনটি। তারা হলেন ঢাবি শাখার সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা, কেন্দ্রীয় পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক তারেক রহমান ও রাফিয়া সুলতানা।

কমিটিকে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সুপারিশসহ ঘটনার বিস্তারিত তথ্য কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের নিকট প্রেরণের নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে সংগঠনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনকে সাময়িকভাবে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের পক্ষে যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান এ নির্দেশ দেন।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল