• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

সখীপুরের গ্রামে গ্রামে চলছে বাউলগানের আসর

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১০ জানুয়ারি ২০২০  

শীত এলেই গ্রামে গ্রামে বসে বাউলগানের আসর। প্রায় রাতেই সখীপুরের পাঁচ–সাতটি স্থানে বাৎসরিক ওরস মাহফিলে বাউলগানের আয়োজন করা হয়। আবহমান বাংলার প্রকৃতি, মাটি ও মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসা একাত্ম হয়ে ফুটে ওঠে বাউলগানে, থাকে সাম্য ও মানবতার বাণী। এ কারণে প্রতিটি আসরেই নানা শ্রেণি–পেশার শত শত গানপ্রেমী মানুষের সমাগম ঘটে। এসব আসরে রাজনৈতিক দলের ভোট প্রার্থীরাও ভোটারদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের জন্য উপস্থিত হন।

এ অঞ্চলের গানপ্রেমীরা প্রতিটি ওরসের দিন–তারিখ মনে রেখে যথাসময়ে উপস্থিত হন। বাউলগানের আসরে বসে ক্ষণিকের জন্য হলেও অন্য এক জগতের বাসিন্দা হয়ে যান ভক্তরা। তাঁদের ভাষায় এ জগৎ ভাবের জগৎ, ভাবের দেশ।


 
বাউলগান মূলত বাউল সম্প্রদায়ের গান, যা বাংলা লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ। সখীপুরে সাধারণত পির–মুরশিদের ভক্ত–আশেকানরা তাঁদের বাৎসরিক ওরস মাহফিলে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট দিনে নিজ বাড়িতে এই গানের আয়োজন করেন। আসরে দুজন শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। রাত ১১টার দিকে আসর শুরু হয়। একজন গান সাধককে আসরের সভাপতি করা হয়। পালাগানের জন্য সভাপতি দুই শিল্পীকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দুটি বিষয় নির্ধারণ করে দেন। পালাগানের বিষয় হিসেবে থাকে নারী-পুরুষ, দেবর-ভাবি, ননদ-ভাবি, শরিয়ত-মারফত, গুরু-শিষ্য, বউ-শাশুড়ি, নবুয়ত-বেলায়েত, নবীর জীবনী-মেরাজ, হাসর-কেয়ামত, জীবাত্মা-পরমাত্মা, হিন্দু-মুসলিম ইত্যাদি।

শিল্পীরা প্রাসঙ্গিক গানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর প্রতিপক্ষকে বিভিন্ন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে গান করেন। প্রতিপক্ষও গানের মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে গান শেষ করেন। এভাবেই রাতব্যাপী চলে গানের আসর। পালাগান ছাড়াও এ অঞ্চলের কোনো কোনো আসরে লালনগীতি, কবিগান, বিজয় বিচ্ছেদ, জালালগীতি ও লীলাকীর্তনের প্রচলন রয়েছে।


 
উপজেলার প্রতিমা বংকী গ্রামের বাউলগানপ্রেমী সাবেক ইউপি সদস্য জিন্নাত আলী জানান, এ অঞ্চলে বিভিন্ন পালাগানের প্রচলন থাকলেও সাধারণত ‘গুরু-শিষ্য’ পালাগানটি বেশি জনপ্রিয়। গুরু-শিষ্যের আসরে গান শুনতে শুনতে একপর্যায়ে গুরুর কথা স্মরণ করে আবেগে আপ্লুত হয়ে ভক্তরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এসব আসরে প্রচুর নারী দর্শকও আসেন। তাঁরা কম্বল গায়ে দিয়ে সারা রাত গান শোনেন।

প্রতি শীত মৌসুমে পাঁচ শতাধিক স্থানে বাউলগানের আসর বসে। এর মধ্যে উপজেলার লাঙ্গুলিয়া গ্রামের কেফাতুল্লাহ চেয়ারম্যানের বাড়ি, পৌর শহরের রফিক কাউন্সিলরের বাড়ি, প্রতিমা বংকী গ্রামের জিয়ারত আলী পিরের বাড়ি, তক্তারচালা বাজারের ছামান পাগলার মেলা, ফয়েজ পির, কচুয়া হানিফ পির, শাহান শাহর বাড়ি, বড়চওনায় আল-আমিন সরকার, ভুয়াইদ কুটুম পাগলার মেলা, গড়গোবিন্দপুরের সবুর পির, লাঙ্গুলিয়ার আমজাদ পির, মিয়া ফকিরের মেলা, কালিদাসের দয়াল শফীর বাড়ি, চতলবাইদ মোশারফ পির, নলুয়ার প্রয়াত শরবেশ খানের বাড়িতে বাৎসরিক ওরস মাহফিলে বাউলগানের আসর উল্লেখযোগ্য।

এসব আসরে দেশবরেণ্য বাউলশিল্পীরা গান পরিবেশন করেন। সখীপুরে সাধারণত বিখ্যাত বাউল শিল্পী কাজল দেওয়ান, লালন সাধক শফি মণ্ডল, ময়মনসিংহের সুনীল বাবু, লতিফ সরকার, আরিফ দেওয়ান, মোতালেব সরকার, ছোট আবুল, বড় আবুল, সমির বাউল, আবির বাউল, হালিম সরকার, মুক্তা সরকার, শিউলি দেওয়ান, স্বপ্না রানী সরকার, মজিদ সরকার, হানিফ সরকার, জালাল সরকারসহ প্রায় শতাধিক বাউলশিল্পী নিয়মিত গান পরিবেশন করেন।


 
উপজেলার বাহারচালা গ্রামের বাউলগানের শিল্পী হালিম সরকার বলেন, সখীপুরসহ ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষ বাউলগানের ভক্ত। মৌসুমের আরও দুই মাস প্রতি রাতেই তাঁর গানের বায়না (চুক্তি) হয়ে গেছে।

বাউলগান নিয়ে টাঙ্গাইলের সরকারি সা’দত কলেজের অধ্যক্ষ গীতিকার, সুরকার ও চর্যা গবেষক অধ্যাপক আলীম মাহমুদ বলেন, বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বাউলগানের যোগসূত্র রয়েছে। আমাদের সাহিত্যের তিনটি ভাগ রয়েছে—প্রাচীন পর্ব, মধ্য পর্ব ও আধুনিক পর্ব। মধ্যযুগের সাহিত্য ধারার শুরু থেকেই বাউলগানের প্রচলন শুরু হয়। বাউলদের মধ্যেও বিভিন্ন মতবাদ লক্ষ করা যায়। দেহত্ববাদী, মারফতি ও শরিয়তি। এসব সমন্বয় করে বাউলগানের প্রবক্তাদের মধ্যে লালন শাহ্, পাঞ্জু শাহ্, সিরাজ শাহ্ ও দুদু শাহ্ বহু বাউলসংগীত রচনা করেছেন। হিন্দুদের মধ্যে বিজয় সরকার অন্যতম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও বাউলগানের সম্পর্ক রয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথও বাউলদের আত্মদর্শন আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁর অনেক সুরের ধারা বাউলগানের সুরের সঙ্গে মিলে যায়। আমাদের জাতীয় সংগীতের সুরও রবীন্দ্রনাথ বাউলদের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইলে যে পালাগান ও বিচ্ছেদগান হয়, সেগুলো বাউলগানেরই অংশ।


 
সখীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জুলফিকার হায়দার কামাল বলেন, ‘আমি প্রায় প্রতি রাতে পাঁচ–ছয়টি আসরে দাওয়াত পেলেও কমপক্ষে দুই-তিনটি আসরে উপস্থিত হই। বাউলশিল্পীরা শেষ রাতের দিকে বিচ্ছেদগান গেয়ে থাকেন। গান আমার ভালো লাগে, তাই শুনি।’

সখীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমির হোসেন জানান, শীত মৌসুমে সখীপুরে প্রতি রাতে কমপক্ষে পাঁচ–সাতটি বাড়িতে বাউলগানের আসর বসে। এসব আসরে পুলিশি নিরাপত্তা থাকে।

আজ শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) রাতে উপজেলার চারটি বাড়িতে বাউল গানের আসর বসবে বলে জানা গেছে।

উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শফিউল ইসলাম জানান, কালিয়া ইউনিয়নের আড়াইপাড়া গ্রামে প্রতি বছর পৌষের পূর্ণিমা রাতে মোসলেম দারোগার বাড়িতে বাউল গানের আসর বসে। এবার বাবলী সরকার ও শিরীন দেওয়ান নামে দুই নারী বাউলশিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

পুলিশের সাবেক উপপরিদর্শক মোসলেম উদ্দিন চিশতির নাতি আবু মুনতাসির বলেন, তাঁর নানার বাড়িতে ৪০ বছর ধরে প্রতি বছর পৌষ মাসের পূর্ণিমা রাতে বাউল গানের আসর বসে। এলাকায় এ গানের আসরকে ‘দারোগার মেলা’ বলে জানে।

এ ছাড়া বহুরিয়া ইউনিয়নের সলঙ্গা পশ্চিমপাড়া গ্রামের আবু হানিফ পীরের বাড়ি, চতলবাইদ গ্রামের শমসের ফকিরের বাড়ি ও গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাদিঘী আতিয়াপাড়া গ্রামের শাহজাহানের বাড়িতে আজ রাতে বাউল গানের আসর বসবে।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল