• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

লেন-দেনে পরিচ্ছন্নতা মুমিনের বৈশিষ্ট্য

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

লেন-দেনে পরিচ্ছন্নতা মুমিনের বৈশিষ্ট্য, আলোচ্য বিষয়টি ইসলামের মুআমালাত অধ্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মুআমালাত ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা আমাদের আকাবিররা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমল করে এবং লিখনি ও বয়ানের মাধ্যমে উম্মতের মধ্যে প্রচার–প্রসার ঘটিয়েছেন। যেমন: মাওলানা মনযূর নোমানী (রহ.) তার ‘মাআরিফুল হাদিস’ গ্রন্থে এর পরিচয় দিয়েছেন এভাবে, বেচা-কেনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষেত-খামার, শিল্প, দেনা-পাওনা, আমানত, হাদিয়া, দান-ছদকা, ওসিয়ত, শ্রম, ভাড়া, মামলা-মোকাদ্দমা, সাক্ষ্যদান, ওকালতি ইত্যাদির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়কে এককথায় ‘মুআমালাত’ বলে।

ইসলামে মুআমালাতের মর্যাদা ও অবস্থান: ইসলামি শরীয়তে সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান বিষয় হচ্ছে ঈমান-আকীদা, যা শুদ্ধ না হলে একজন ব্যক্তি মুসলমানই হতে পারে না। ঈমান-আকীদার পর সবচে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইবাদত-বন্দেগীর অধ্যায়। এর পরেই মুআমালাত ও মুআশারাতের স্থান। কিন্তু ইসলামি শরীয়তের অধ্যায়গুলোর একটিকে আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। সব অধ্যায় একই সুতোয় গাঁথা। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন-

 

مَا خَطَبَنَا رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ خُطْبَةً قَطّ إِلّا قَالَ إِنّهُ لا إِيمَانَ لِمَنْ لا أَمَانَةَ لَهُ وَلا دِينَ لِمَنْ لا عَهْدَ لَهُ.

 

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম-(স্বাভাবিকভাবে) এ কথাটি বলতেন- ‘যার আমানতদারি নেই তার ঈমান নেই। যার প্রতিশ্রুতির ঠিক নেই তার দ্বীন নেই’(মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ১২৩৮৩)।

 

অনুরূপভাবে মুসলিম শরিফের এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘যার উপার্জন হারাম আল্লাহ পাক তার দোয়া কবুল করেন না।’ (হাদিস ১০১৫)।

 

অন্য এক হাদিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা দিয়েছেন,

 

لَا تُقْبَلُ صَلَاةٌ بِغَيْرِ طُهُورٍ وَلَا صَدَقَةٌ مِنْ غُلُولٍ.

 

‘ওজু ছাড়া নামাজ কবুল হয় না; আর আত্মসাতের (অর্থাৎ অবৈধভাবে উপার্জিত) সম্পদের সদকাও কবুল হয় না’(সহিহ মুসলিম-খ:, ১ পৃ:১১৯, হাদিস ২২৪)।

 

সুতরাং ঈমান-আকীদা ও ইবাদতের সঙ্গে মুআমালাতের যোগসূত্র অতি গভীর ও সুদৃঢ়। ইসলামী শরীয়তে অনেক দিক থেকেই মুআমালাতের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে। এই সীমিত পরিসরে শুধু চারটি দিক নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।

 

(এক) মুআমালাত অধ্যায়টি শরীয়তে ইসলামের একটি বিস্তৃত অধ্যায়। ইসলামি আইনশাস্ত্রের (ফিকাহ শাস্ত্র) গ্রন্থাদি খুললেই দেখা যাবে, এই অধ্যায়ের আলোচনা কতটা বিস্তৃত।একজন মুসলমানের গোটা জীবনে মুআমালাতের বিধি-নিষেধ সর্বাধিক বেশি পরিমাণ দরকার পড়ে। কারণ মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে চলতে হলে তাকে সবার সঙ্গে ওঠা-বসা, লেনদেন করেই চলতে হয়। লেনদেনের মাধ্যমে জীবন যাপন করা ছাড়া কারো পক্ষে ঠিকমতো ইবাদত-বন্দেগী পালনও সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই ইসলামি শরীয়তে মুআমালাত ও লেনদেনের গুরুত্ব অনেক বেশি। এর জন্য বিপুল পরিমাণে স্বতন্ত্র বিধান দেয়া হয়েছে।

 

(দুই) ইসলামী শরীয়তে হকসমূহ (অধিকার ও দায়-দায়িত্ব) দুই ভাগে বিভক্ত। (১) আল্লাহ পাকের হক। (২) বান্দার হক। 

 

আল্লাহর হকের ক্ষেত্রে যদি বান্দার কোনো ত্রুটি হয়ে যায়; আর সে তওবা করে নেয় অথবা ক্ষেত্র বিশেষে তওবা ছাড়াও যদি আল্লাহর মর্জি হয়; তবে সে ক্ষমা পেতে পারে। কিন্তু বান্দার হকের ব্যাপারে কেউ ত্রুটি করলে সেটা আল্লাহ ক্ষমা করেন না; যতক্ষণ না অপরাধী নিজেই হকদারের সঙ্গে লেনদেন সাফ করে নেয়।

 

(তিন) ইসলামের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মুআমালাতের বিধি-নিষেধ মেনে চললে ইসলাম তার জন্য আলাদা পুরস্কার ও সওয়াবের ঘোষণা দিয়েছে। 

হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে,

 

التّاجِرُ الصّدُوقُ الْأَمِينُ مَعَ النّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشّهَدَاءِ.

 

‘সত্যবাদী-বিশ্বস্ত ও আমানতদার ব্যবসায়ী নবী, সিদ্দীক ও শহীদদের সঙ্গে হাশর হবে।’ (জামে তিরমিযী, হাদিস: ১২০৯; সুনানে দারেমী, হাদিস: ২৫৪২)।

 

(চার) ইসলামি শরীয়তে মুআমালাতের বিশেষ গুরুত্বের আরেকটি দিক হলো, এটি আল্লাহ কর্তৃক বান্দার পরীক্ষার এক কঠিন ময়দান। কেননা অন্যান্য ময়দানের তুলনায় এখানে বান্দার পার্থিব কল্যাণ ও প্রবৃত্তির চাহিদা একটু বেশিই বিদ্যমান। ফলে শরীয়তের বিধি-বিধানের সঙ্গে নফসের মোজাহাদা ও দ্বন্ধও হয় বেশি। উদাহরণ স্বরূপ : ব্যবসা-বাণিজ্যে বান্দার নিজস্ব উপকারিতা বেশি নজরে আসে। প্রবৃত্তির টানও এই থাকে যে, সত্য-মিথ্যা, জায়েয-নাজায়েযের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে যেভাবে লাভ বেশি হয় সেই পন্থাই অবলম্বন করা। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার বিধান বলে, খবরদার! বাহ্যিকভাবে তোমার বিরাট ক্ষতি হয় হোক, তবুও তুমি মিথ্যা, ওজনে কম দেয়া, ভেজাল অথবা কারো সঙ্গে প্রতারণা করতে পারবে না। আল্লাহ পাক তোমার জন্য যে পন্থা হালাল করেছেন তুমি সেটাই অবলম্বন করবে।

 

কোরআন মাজীদে লেনদেনে পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ: কোরআন-হাদিসে অতি গুরুত্বের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছ থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিভিন্নভাবে ও নানা আঙ্গিকে এ ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। এখানে তার কিছু নমুনা পেশ করা হলো।

 

সূরা মুতাফ্ফিফীনের শুরুতেই আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন,

 

فویْلٌ لِّلْمُطَفِّفِیْنَ، الَّذِیْنَ اِذَا اكْتَالُوْا عَلَی النَّاسِ یَسْتَوْفُوْنَ، وَ اِذَا كَالُوْهُمْ اَوْ وَّ زَنُوْهُمْ یُخْسِرُوْنَ، اَلَا یَظُنُّ اُولٰٓىِٕكَ اَنَّهُمْ مَّبْعُوْثُوْنَ، لِیَوْمٍ عَظِیْمٍ،  یَّوْمَ یَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعٰلَمِیْنَ.

 

‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়। যারা মানুষের নিকট থেকে যখন মেপে নেয়, পূর্ণমাত্রায় নেয়। আর যখন অন্যকে মেপে বা ওজন করে দেয় তখন কমিয়ে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না, তাদেরকে এক মহা দিবসে জীবিত করে ওঠানো হবে? যেদিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামিনের সামনে দাঁড়াবে।’ (সূরা: মুতাফ্ফিফীন, আয়াত: ১-৬)।

 

ইয়াতিমদের সম্পদ সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে কোরআনে লেনদেনের অনেক বড় মূলনীতি বলে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,

 

وَآتُوا الْيَتَامَى أَمْوَالَهُمْ وَلَا تَتَبَدَّلُوا الْخَبِيثَ بِالطَّيِّبِ وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَهُمْ إِلَى أَمْوَالِكُمْ إِنَّهُ كَانَ حُوبًا كَبِيرًا

 

‘ইয়াতিমদেরকে তাদের সম্পদ দিয়ে দাও। আর ভালো মালকে মন্দ মাল দ্বারা পরিবর্তন করো না। তাদের (ইয়াতিমদের) সম্পদকে নিজেদের সম্পদের সঙ্গে মিশিয়ে খেয়ো না। নিশ্চয়ই তা মহাপাপ।’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ২)।

 

এক আয়াতে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আল্লাহ পাক ঘোষণা দিয়েছেন,

 

إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَال الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا 

 

‘নিশ্চয়ই যারা ইয়াতিমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে; তারা নিজেদের পেটে কেবল আগুন ভর্তি করে। তারা অচিরেই এক জলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে।’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ১০)।

 

এক আয়াতে পরস্পর সন্তুষ্টির ভিত্তিতে বেচা-কেনাকে বৈধতা দিয়ে সম্পদ উপার্জনের অন্য সব অন্যায় পদ্ধতিকে হারাম ঘোষণা করেছেন। বলেছেন,

 

يأیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَكُمْ بَیْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ اِلَّاۤ اَنْ تَكُوْنَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِّنْكُمْ

 

‘হে মুমিনগণ! তোমরা পরস্পরে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। তবে পারস্পরিক সম্মতিক্রমে কোনো ব্যবসা করা হলে (তা জায়েয)।’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ২৯)।

 

কোনো সম্পদ শুধু বিচারকের কাছ থেকে নিজের নামে ফায়সালা করে নিলেই তা বৈধ হয়ে যায় না; বরং পন্থাও বৈধ হতে হয় এবং বাস্তবেই নিজে ওই সম্পদের হকদার হতে হয়। এ বিষয়ে কোরআনের এক আয়াতে নির্দেশনা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,

 

وَ لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَكُمْ بَیْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَ تُدْلُوْا بِهَاۤ اِلَی الْحُكَّامِ لِتَاْكُلُوْا فَرِیْقًا مِّنْ اَمْوَالِ النَّاسِ بِالْاِثْمِ وَ اَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ.

 

‘তোমরা পরস্পর একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং বিচারকের কাছে সে সম্পর্কে এই উদ্দেশ্যে মামলা রুজু করো না যে, মানুষের সম্পদ থেকে কোনো অংশ জেনে-শুনে পাপের পথে গ্রাস করবে’ (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৮৮)।

 

ক্রয়-বিক্রয়সহ বিভিন্ন সময় আমরা যে চুক্তি করি তা পরিপূর্ণ করার ব্যাপারে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন,

 

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُود

 

‘হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গিকার পুরা করো। অর্থাৎ লেনদেনের বিভিন্ন অঙ্গিকার ও অন্যান্য অঙ্গিকার’ (সূরা: মায়েদা, আয়াত: ১)। 

 

অনেকে আমাদের কাছে বিভিন্ন জিনিস আমানত রাখে। আবার বিভিন্ন সময় নানা প্রয়োজনে আমরাও অনেক কিছু ধার-কর্জ করি। অথবা যে কোনোভাবে অপরের কোনো জিনিস আমাদের কাছে থাকে; এ অবস্থায় পাওনাদারের জিনিস বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,

 

اِإِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا 

 

‘(হে মুসলিমগণ!) নিশ্চয়ই আল্লাহপাক তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানত ও পাওনা তার হকদারকে আদায় করে দেবে। আর যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে; ইনসাফের সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কতই না উৎকৃষ্ট! নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ৫৮)।

 

খাঁটি মুমিনদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহপাক কোরআনের দুই জায়গায় ইরশাদ করেছেন,

 

‘এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং যারা তাদের সাক্ষ্য যথাযথভাবে দান করে’ (সূরা: মাআরিজ, আয়াত: ৩২-৩৩; সূরা মুমিনূন: ৮)।

 

এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) এর একটি বড় শিক্ষণীয় ঘটনা আছে। তাঁর সময়ে বসরার আমীর ছিল আব্দুল্লাহ বিন আমের। সে মুসলমানদের বায়তুল মাল থেকে তার প্রাপ্যের চেয়ে বেশি গ্রহণ করত। কিন্তু তার স্বভাব ছিল, সে এসব সম্পদ গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিত, মসজিদ নির্মাণের কাজে খরচ করত, বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করত। যখন সে মৃত্যুশয্যায় উপনীত হলো তখন লোকজন তার চারপাশে ভিড় জমাল এবং তার দান-দাক্ষিণ্য ও মানুষের প্রতি তার অনুগ্রহের ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগল। কিন্তু ইবনে ওমর (রা.) চুপচাপ রইলেন। যখন বসরার আমীর ইবনে আমের স্বয়ং তাকে কথা বলতে ও নিজের জন্য দোয়া করতে আবেদন করল; তখন তিনি তাকে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদিস শুনালেন-

 

إِنّ اللهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى لَا يَقْبَلُ صَدَقَةً مِنْ غُلُولٍ

 

আল্লাহপাক আত্মসাতের মালের সদকা কবুল করেন না। অতঃপর তাকে বললেন, তুমি তো বসরা শহরেরই আমীর ছিলে। অর্থাৎ আমি তোমার কীর্তি-কর্ম সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত যে, তুমি বায়তুল মালের সম্পদ না-হক ভাবে গ্রহণ করতে। সুতরাং কীভাবে তোমার এসব দান-সদকা কবুল হবে? আর তোমার জন্যে দোয়া করলে সেই দোয়াই বা কীভাবে কবুল হবে? (সহিহ মুসলিম খ:, ১ পৃ: ১১৯, হাদিস ২২৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৪৭০০, ৫৪১৯; জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম, পৃ. ১৮৯)।

 

হারাম হতে সৃষ্ট শরীর জান্নাতে যাবে না: হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

 

إِنّهُ لَا يَدْخُلُ الْجَنّةَ لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ سُحْت، النّارُ أَوْلَى بِهِ

 

‘এমন শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার মাংস ও রক্ত হারাম উপার্জিত অর্থের খাদ্য দ্বারা বর্ধিত। জাহান্নামই তার উপযুক্ত স্থান’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ১৪৪৪১; মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, হাদিস ২০৭১৯; মুসনাদে আবদ ইবনে হুমাইদ, হাদিস ১১৩৮)।

 

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার হজরত কাব বিন উজরাহ (রা.)-কে ডেকে বললেন, হে কাব! শুনে রাখো, ওই দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যা হারাম হতে সৃষ্ট। কেননা জাহান্নামের আগুনই তার অধিক উপযোগী’ (জামে তিরমিযী, হাদীস ৬১৪; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, ১৯/২১২)।

 

হারাম মাল সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সদকা করার প্রসঙ্গ: ইসলামের অমোঘ বিধান তো হলো, কেউ হারাম পথে সম্পদ উপার্জন করবে না। কিন্তু এরপরেও যদি কেউ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অন্যায় পথে সম্পদ উপার্জন করে ফেলে অথবা কোনোভাবে যদি হারাম সম্পদ কারো কাছে জমা হয়ে যায়, তাহলে তার জন্য এই পাপ থেকে তাওবা করা আবশ্যক। 

এক্ষেত্রে তাওবার অপরিহার্য একটি শর্ত হলো, যার হক নষ্ট হয়েছে তার হক যথাযথভাবে তার নিকট পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ অবস্থায় তাওবাকারীর সামনে স্বাভাবিকভাবে কয়েকটি সুরত আসে। 

 

(এক) তাওবাকারী নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির হক নষ্ট করেছে। এক্ষেত্রে সে যেভাবেই হোক পাওনাদারের হক তার কাছেই পৌঁছে দেবে। বিখ্যাত তাবেঈ হজরত হাসান বসরী (রাহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কারো কোনো সম্পদ (অন্যায়ভাবে) কুক্ষিগত করল, অথবা কারো থেকে কোনো কিছু চুরি করল অতঃপর এমন পদ্ধতিতে সেই সম্পদ মূল মালিকের কাছে পৌঁছে দিতে চাইল যাতে সে জানতে না পারে; তাহলে সে তা করতে পারবে’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস: ২৩৫৯৬)।

 

(দুই) সুনির্দিষ্টভাবে কারো হক নষ্ট করেনি বরং জনগণের সম্মিলিত হক নষ্ট করেছে। তাহলে আল্লামা ইবনুল জাওযী (রাহ.) এর ভাষ্যমতে যেই খাত থেকে অন্যায়ভাবে নিয়েছে সেখানেই হক পৌঁছে দেবে। যেমন: রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিয়ে থাকলে সেখানে পৌঁছে দেবে। এই সম্পদ গরীবদের মাঝে সদকা করলে হবে না’ (জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম, পৃ: ২৬৬)।

 

(তিন) কারো হক নষ্ট করা ছাড়া শরীয়ত কর্তৃক হারাম পন্থায় উপার্জিত সম্পদের মালিক হয়েছে। যেমন: শূকর, মদ ইত্যাদি বিক্রয় করা সম্পদ। জুয়ার মাধ্যমে উপার্জিত সম্পদ। শরীয়তের  অনুনোমোদিত পন্থায় ক্রয়কৃত সম্পদ। এক্ষেত্রে বিধান হলো, ওই সম্পদ সওয়াবের নিয়ত ব্যতীত দ্বীনি কোনো স্থানে দান-সদকা করে দেবে।

 

(চার) তাওবাকারী কার থেকে বা কোন খাত থেকে নিয়েছে তা জানে না। তার পক্ষে জানা সম্ভবও নয়। তাহলে পূর্বের সুরতের ন্যায় এক্ষেত্রেও সওয়াবের নিয়ত ব্যতীত সদকা করে দেবে। এক ব্যক্তি বিশিষ্ট তাবেঈ হজরত আতা বিন আবী রাবাহ (রাহ.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, আমি যখন অল্প বয়স্ক ছিলাম তখন এমন পন্থায় মাল উপার্জন করতাম, যা আমি এখন পছন্দ করি না (অর্থাৎ অবৈধ পন্থায়)। আমি তাওবা করতে চাই। তখন তিনি তাকে বললেন,

 

‘তুমি এ মাল তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দাও। সে বলল, আমি তো এখন তাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। তিনি বললেন, তাহলে তা সদকা করে দাও। এতে তোমার কোনো সওয়াব হবে না। তুমি এর গোনাহ থেকে মুক্তি পাবে কি না তাও বলতে পারব না’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস: ২৩৫৯৪)।

 

হজরত মুজাহিদ (রাহ.) থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ হারাম মাল সওয়াবের নিয়ত ব্যতীত সদকা করে দেবে। তবে এই সদকার বিধান তখনই প্রযোজ্য যখন হকদারের কাছে তা পৌঁছানো সম্ভব হবে না। নতুবা আসল বিধান হলো পাওনা তার হকদারকেই পৌঁছে দেয়া।

 

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে লেন-দেনে পরিচ্ছন্ন হওয়ার এবং বান্দার হকের বিষয়ে সচেতন হওয়ার তাওফীক দান করুন। হালাল উপার্জনে বরকত দান করুন, হারাম থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল