• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইল সদর হাসপাতাল:

রোগী দেখলেই প্রেসক্রিপশন নিয়ে টানা-টানি

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১৭ জুলাই ২০১৯  

গলার সমস্যা নিয়ে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন নাগরপুর উপজেলা থেকে আব্দুলাহ (৩০)। বহিঃবিভাগের দ্বিতীয় তলায় নাক কান গলার ডাক্তার এসসি পন্ডিতকে দেখানোর পর বের হতেই কয়েকজন মেডিকেল প্রতিনিধি কোন কথা না বলে হাত থেকে চিকিৎসা পত্র (প্রেসক্রিপশন) নিয়ে ছবি তুলতে থাকে। দ্বিতীয় তলা থেকে নিচতলায় নামার সাথে সাথে আরো ৬-৭ জন তার হাতে থাকা প্রেসক্রিপশন নিয়ে টানা-হেচড়া শুরু করে।
এ তো গেল হাসপাতালের ভিতরের চিত্র। হাসপাতাল থেকে বাহির হওয়ার সময় জরুরি বিভাগে সামনে কয়েকজন দালাল এগিয়ে এসে তার সাথে কথা বলেন। কেউ বলেন, আমার দোকান থেকে ওষুধ এনে দেই। আবার কেউ বলেন, আমার কাছে সীমিত দামের ওষুধ পাবেন। এমন চিত্র দেখা যায় বুধবার সকালে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে। এটি শুধু বুধবারের চিত্র তা নয়। প্রতিদিনই এরকম হয়রানির শিকার হতে হয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা হাজারো রোগীর।

১২টি উপজেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষের উন্নত চিকিৎসার ভরসার স্থান ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল। ২৫০ শয্যা হলেও গড়ে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৫৫০ রোগী ভর্তি থাকে এই হাসপাতালে। এছাড়াও বহিঃবিভাগে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬শ’ রোগী আসেন চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে। এসব রোগীদের প্রতিনিয়ত দালাল ও মেডিকেল প্রতিনিধিদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হতে হয়। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির উদ্যোগে একাধিকবার দালাল মুক্ত করণের লক্ষ্যে অভিযান পরিচালনা করে কয়েকজনকে জেল জরিমানাও করা হয়েছে। কিছুদিন পর জেল থেকে বের হয়ে আবার একই পেশায় ফিরে আসছেন তারা। এছাড়াও হাসপাতালের সামনের অবৈধ অর্ধশতাধিক ভ্রাম্যমান ওষুধের দোকানও অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারো পূর্বের জায়গা দখল করে বসে তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের সামনে ও পশ্চিম পাশে প্রায় অর্ধশতাধিক অবৈধ ভ্রাম্যমাণ ওষুধের দোকান রয়েছে। এই দোকানগুলোর আবার প্রায় শতাধিক দালাল রয়েছে। তারা হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগে ঘুরে ঘুরে রোগী ও রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে চিকিৎসাপত্র নিয়ে ওষুধ বিক্রি করে থাকে। এছাড়াও জেনারেল হাসপাতালে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর প্রায় দুই শতাধিক মেডিকেল প্রতিনিধি রোগীদের চিকিৎসাপত্র নিয়ে টানা হেচড়া করে। এতে প্রতিনিয়তই হয়রানি শিকার হতে হচ্ছে রোগীদের। হয়রানি থেকে রেহাই পেতে হাসপাতালের সামনের অবৈধ স্থাপনা, মেডিকেল প্রতিনিধি ও দালাল মুক্ত হাসপাতালের দাবি জানিয়েছেন সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা।

বুধবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের গ্যারেজের সামনে প্রায় শতাধিক মেডিকেল প্রতিনিধিদের মোটরসাইকেল পার্কিং করে রাখা আছে। অনেকেই আবার মোটরসাইকেলে উপরে বসে রয়েছেন। জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনেই ৫ জন মেডিকেল প্রতিনিধি রোগীর প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলছেন। জরুরি বিভাগে উত্তর পাশে কয়েকজন যুবককে বসে আড্ডা দিতে দেখা যায়। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেলো, তারা হাসপাতালের দালাল। শুধু ওই যুবকগুলোই নয় বিভিন্ন বয়সের প্রায় অর্ধশতাধিক দালালের আনাগোনা এ হাসপাতালে। জরুরি বিভাগের দক্ষিণ পাশে গিয়ে দেখা যায় ১২-১৩ জন মেডিকেল প্রতিনিধি দাঁড়িয়ে আছেন। দ্বিতীয় তলা থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে রোগীরা নামছেন আর মেডিকেল প্রতিনিধিরা সেটা নিয়ে মোবাইল দিয়ে ছবি তুলছেন।

সরকারি ওষুধ বিপণন কক্ষের সামনে গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। এখানে কথা হয় পৌরসভার কাগমারা এলাকার মীম আক্তারের সাথে। তিনি বলেন, জ্বর নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলাম। ডাক্তারের কাছ থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই কয়েকজন লোক আমার প্রেসক্রিপশন নিয়ে মোবাইলে ছবি তোলা শুরু করলো। আমি এমনিতেই রোগী মানুষ, তাতে আবার হয়রানি। সেবা নিতে এসে যেন কোন হয়রানির শিকার হতে না হয় সেই জন্য ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিমুক্ত হাসপাতালের দাবি করছি।

মো. সবুজ মিয়া নামের এক রোগীর স্বজন বলেন, আমি সদর উপজেলা সদুল্যাপুর থেকে হাসপাতালে এসেছি। আমার ছোট ভাইয়ের জ্বর হয়েছে। তাকে ডাক্তার দেখিয়ে দ্বিতীয় তলা থেকে নিচতলা পর্যন্ত আসতে আমাদের প্রেসক্রিপশনটি প্রায় ১৩-১৪ জন নিয়ে ছবি তুলেছেন। মনে হচ্ছিলো আমরা হয়তো হাসপাতালে না এসে অন্য কোথাও এসেছি।

মো. কালাম নামে রোগীর এক স্বজন বলেন, আমার রোগীর জন্য ইউরিন ব্যাগ আনতে বলেন চিকিৎসক। ইউরিন ব্যাগ আনতে যাওয়ার সময় জরুরি বিভাগের সামনে এক যুবক জিজ্ঞেস করেন কাকা কই যান?  আমি বললাম ওষুধ আনতে। ওই যুবক বললেন, ৫০ টাকা দেন আমি এনে দেই। পরে টাকা দেয়ার পর সে আমাকে ইউরিন ব্যাগ এনে দেন। খোঁজ নিয়ে দেখি ইউরিন ব্যাগের দাম ৩০ টাকা। আমরা সহজ সরল মানুষ। হাসপাতালে এসে যদি এভাবে হয়রানির শিকার হই, তাহলে আমরা কোথায় যাব।

প্রদীপ সরকার নামে এক রোগী বলেন, ডাক্তার দেখানো শেষে পেসক্রিপশন নিয়ে আসার সময় এক ছেলে বলে আমার দোকানে চলেন কম দামে ওষুধ দেব। সেই হাসপাতালের গেট থেকে ১০০ টাকা নিয়ে একটা তুসকা সিরাপ দিয়েছে। পাশের দোকানে দাম শুনে জানতে পারি ওই সিরাপের দাম ৮০ টাকা। আমরা যারা সাধারণ মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে হয়রানি শিকার হই এর দায় কে নেবে? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ না অন্য কেউ।

হাসপাতালে দালারদের ছবি তোলার সময় মো. হাবিব নামের এক দালাল বলেন, ভাই আমাদের ছবি তুইলেন না। এ পর্যন্ত ৩ বার জেল খেটেছি। আমি এখানে ৭ বছর যাবত আছি। আমার কাজ হলো রোগীর স্বজনদের সাথে কথা বলে দোকান থেকে ওষুধ এনে দেয়া। তারা যদি খুশি হয়ে কিছু টাকা দেয় তাতেই আমি খুশি। অপর দালাল মো. রাব্বি বলেন, আমি প্রায় ৮ বছর যাব এই হাসপাতালে আছি। এর আগেও কয়েকবার জেল খেটেছি। এই কাজ করেই কোন রকম সংসার চালাই।

বাংলাদেশ ফার্মাসিটিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ এ্যাসোসিয়েশনের (ফারিয়া) উপদেষ্টা আহমেদুল হক রতন সিদ্দিকী বলেন, মেডিকেল প্রতিনিধিদের প্রতিদিন হাসপাতালে প্রবেশ, রোগীদের চিকিৎসাপত্র নিয়ে টানা হেচড়া করার কোন নিয়ম নেই। দালালমুক্ত টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল চাই।
 
টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল সেবা গ্রহীতা ফোরামের সভাপতি হারুন-অর-রশিদ বলেন, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় একাধিকবার আলোচনা করে দালালদের গ্রেফতার করানো হয়েছে। আবারো অভিযান পরিচালনা করা হবে।

টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক নারায়ন চন্দ্র সাহা জানান, টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের বহিঃবিভাগে ১৫ জন ডাক্তার, ইনডোরে ৯ বিভাগে ৯ জন, জরুরি বিভাগে ৪ জন থাকার কথা থাকলেও তিনজন দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে হচ্ছে। ২৫০ বেডের টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল হলেও প্রতিনিয়ত এখানে দেড় থেকে দুইগুণ কখনো আবার তিনগুণ রোগী ভর্তি থাকে। গড়ে প্রতিদিন ৫৫০ জন ভর্তি রোগী চিকিৎসা সেবা নেন।

তিনি আরো বলেন, মেডিকেল প্রতিনিধিদের সপ্তাহে রোববার ও বুধবার (সকাল ৯ টার আগে ও দুপুর ১ টার পরে) হাসাপাতলে প্রবেশের অনুমতি রয়েছে। তবে তারা কোন নিয়ম কানুনই মানেন না। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় একাধিকবার হাসপাতালের সামনে অবৈধ ওষুধের দোকান, মেডিকেল প্রতিনিধিদের হয়রানি ও দালাল নির্মূলের প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। একাধিকবার পুলিশ, র‌্যাব ও ডিবি দিয়ে হাসপাতালের দালাল গ্রেফতার করানোর পরও তারা হাসপাতালে এসে একই কাজ করেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে হাসপাতালের সামনে অবৈধ স্থাপনা, মেডিকেল প্রতিনিধি ও দালাল দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল