• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

বিশ্বের নতুন হলুদ পদ্ম পাওয়া গেলো বাংলাদেশে

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০  

লাল, গোলাপি বা সাদা নয়, এমনকি আমাদের সাহিত্য ও মিথে স্থায়ী জায়গা করে নেওয়া নীলও নয়; হলুদ রঙের এক পদ্মের সন্ধান মিলেছে বাংলাদেশে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে এটি বিশ্বে পদ্মফুলের সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রজাতি বলে অনুমিত। গবেষণাগারের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে উদ্ভিদবিজ্ঞানে হলুদ পদ্ম হবে অনন্য সংযোজন। এই পদ্মের নামকরণও হবে আমাদের দেওয়া নামে।

 

ফোনের ওপার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাখহরি সরকার যখন প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো পদ্মফুলের নতুন প্রজাতি নিয়ে বলছিলেন, ফোনের এপার থেকে তার কণ্ঠের আবেগ, উষ্ণতা বেশ উপলব্ধি করা যাচ্ছিল।

 

কয়েকদিনের মধ্যে তাদের গবেষক দল যাচ্ছে হলুদ পদ্মের আবাস কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার দক্ষিণগ্রাম বিলে। তিনি আমাকেও আমন্ত্রণ জানালেন হলুদ পদ্ম পর্যবেক্ষণের জন্য।

 

পদ্মফুল পৃথিবীজুড়েই কমবেশি জন্মে। বৈশিষ্ট্য অনুসারে পদ্মকে দুটি প্রজাতিতে ভাগ করা হয়ে থাকে, যেমন- এশিয়ান বা ইন্ডিয়ান পদ্ম। এর বৈজ্ঞানিক নাম Nelumbo nucifera। অন্যটি আমেরিকান বা ইয়োলো লোটাস। ইয়োলো লোটাসের বৈজ্ঞানিক নাম Nelumbo Lutea.

 

এশিয়ান পদ্ম আবার দুই রঙে দেখা যায়- মসৃণ সাদা ও হালকা গোলাপি। আমাদের দেশে ঝিল-বিল ও জলাশয়ে যেসব পদ্মফুল দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো এশিয়ান বা ইন্ডিয়ান লোটাস। শুধু বাংলাদেশ নয়, কাস্পিয়ান সাগর থেকে উত্তর অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত চীন, জাপান, কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে এই প্রজাতির পদ্ম জন্মে। বহুবর্ষজীবী এ জলজ উদ্ভিদের গাছের কাণ্ড লতানো। গোলাকার পাতা গড়ে প্রায় ৪৫ সেন্টিমিটার চওড়া। সরু কাঁটাযুক্ত লম্বা ডাঁটায় ফুল ফোটে। ফুলে রয়েছে মিষ্টি গন্ধ। পানির ওপরে পাতা ও ফুল ভেসে থাকে। চার-পাঁচ ফুট পানি পদ্মের জন্য আদর্শ। পানির নিচে কাদায় বিস্তৃত হয় এর শিকড়।

 

রাখহরি সরকার বললেন, আমাদের বিলে-ঝিলে ফুটে থাকা এশিয়ান পদ্ম থেকে নতুন এই পদ্ম আলাদা। তাহলে কি আমেরিকান লোটাস কোনোভাবে দক্ষিণ গ্রামের এই বিলে এসে বংশবিস্তার করেছে? তার ভাষ্য- সেটিও না। আমেরিকান লোটাসের রঙ ও বৈশিষ্ট্য থেকে দক্ষিণ গ্রাম বিলের পদ্মের বৈশিষ্ট্য আলাদা। এর বর্ণ হালকা আবার পাপড়ির সংখ্যাও অনেক বেশি। সে যাই হোক, গেলেই তো বোঝা যাবে মোহনীয় পদ্ম দক্ষিণ গ্রাম বিলে এসে কতটা ঈর্ষণীয় হয়ে ফুটছে, কতটাই-বা আলাদা জাতভাইদের চেয়ে।

 

গবেষক দলের দুই সদস্য পদ্ম গবেষক শিকদার একে শামসুদ্দিন ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক শাওন মিত্র একদিন আগেই রওনা হয়ে যান। আমি যাই পরের দিন ২ সেপ্টেম্বর। বাসে ঢাকা থেকে কুমিল্লা গিয়ে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানের পাশ থেকে উঠতে হলো বুড়িচং যাওয়ার স্কুটারে। আধা ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে- দক্ষিণ গ্রাম বাজারে। ঘড়িতে তখন সকাল ১১টা। পদ্ম গবেষক শিকদার এ কে শামসুদ্দিন এবং সহযোগী শাওন মিত্র এরই মধ্যে একবার বিল ঘুরে এসেছেন। বললেন, বিকেলে আবার যাব, তখন আপনিও যাবেন।

 

রাখহরি সরকার বলেছিলেন, গত বছর সেপ্টেম্বরে তারা এই হলুদ পদ্মের কথা জানতে পারেন। খবরটা পেয়েই বেঙ্গল প্লান্ট রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক, পদ্ম গবেষক শিকদার এ কে শামসুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেন। সিদ্ধান্ত নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ ও বেঙ্গল প্লান্ট রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট যৌথভাবে হলুদ পদ্মের অনুসন্ধানে নামবে। সেই থেকে কাজ শুরু। গত বছরই ছবিসহ কিছু তথ্য-উপাত্ত যুক্তরাষ্ট্রে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির নামকরণ বিভাগ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় হারবেরিয়াম জাদুঘর ইংল্যান্ডের কিউ গার্ডেনে পাঠিয়েছেন। তারাও বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী। তাই এ বছর হলুদ পদ্মের হারবেরিয়াম শিট করাসহ গবেষণার প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে ফেলতে চান। এলাকাবাসীসহ স্থানীয় প্রশাসন সর্বতোভাবে সহযোগিতা করছেন তাদের এই গবেষণায়। একটু পরেই সেটি বোঝা গেল। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে 'দক্ষিণ গ্রাম সমাজ কল্যাণ সংগঠন'-এর নাসির উদ্দিনের বাড়িতে। তিনি বাড়ির দুটি ঘরই শুধু ছেড়ে দেননি, একটু পরপর এসে খোঁজ নিচ্ছিলেন কিছু লাগবে কিনা। আর চা-নাশতা তো ছিলই। বিকেল ৪টার দিকে আমরা বিলের দিকে যাই।

 

ঠিক হলুদ নয়, হলুদাভ। অফহোয়াইটও বলা যেতে পারে। তবে, সাদা কখনোই নয়। অপূর্ব সুন্দর। যেন অসংখ্য পাপড়ির একটি তোড়া সবুজ পাতা ভেদ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। পূর্ণ ফোটা হলুদ পদ্মের পাশে গোলাপি পদ্মটি দেখতে কিছুটা রুগ্‌ণই মনে হচ্ছিল। যদিও পাপড়ির দৈর্ঘ্য গোলাপি পদ্মেরই বড়।

 

নৌকায় করে সকালে রেকি করার সময় পরদিন ফুটবে এমন কিছু কলিতে ট্যাগ লাগানো হলো। দূর থেকে বোঝার জন্য পুঁতে দেওয়া হলো লাল পতাকা লাগানো বাঁশ। এসব করতে করতেই শিকদার শামসুদ্দিন দেখাচ্ছিলেন, অন্য পদ্ম থেকে হলুদ পদ্মের পার্থক্য।

 

এশিয়ান বা আমেরিকান পদ্মে একটি ফুলে পাপড়ি থাকে ১২ থেকে ১৮টি, সেখানে বুড়িচংয়ের এই হলুদ পদ্মে পাপড়ি সংখ্যা ৬০টিরও বেশি। ভেতরের পাপড়ি পুংকেশরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই ফুলে পুংকেশরের সংখ্যাও অনেক বেশি, প্রায় তিনশ'। গবেষকরা জানালেন, এশিয়ান পদ্মে তা দুইশ'র মধ্যেই থাকে। পাপড়ি ছোট এবং বেশি হওয়ায় হলুদ পদ্মের কলি একটু বেঁটে, পেট মোটা হয়।

 

কথায় কথায় সন্ধ্যা নামে। আমরাও পাড়ে ফিরে আসি। পরদিন ভোর ৫টায় আবার বিলে নেমে পড়ি। পৌঁছে যাই ট্যাগ লাগানো কলিগুলোর কাছে। আস্তে আস্তে আঁধার কাটছে আর ফুলগুলোও যেন একটু করে হেসে উঠছে। আমরা ঘুরে ঘুরে পদ্মের কলি থেকে ফুল হওয়া দেখি। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই চারদিক আলো ঝলমল করে উঠল। সেইসঙ্গে বিলের সব হলুদাভ পদ্ম গ্রীবা তুলে নিজেদের মেলে ধরে।

 

পদ্মের আয়ু চার দিন। গবেষকরা এই চার দিন ফুলগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন। হলুদ পদ্মের পাতা, ডাঁটা, ফুল, ফল, শিকড় প্রভৃতি সংগ্রহ করবেন। তৈরি করবেন হারবেরিয়াম শিট। নমুনা থেকে করবেন ডিএনএ টেস্ট। 'যদি স্বাতন্ত্র্য প্রমাণিত হয় এই পদ্ম আমাদের হবে'- আনন্দে শিকদার শামসুদ্দিনের মুখ ঝলমল করে ওঠে। খালি চোখেই যা অন্যদের থেকে ভিন্ন-অনন্য, গবেষণাতেও তা ফুটে উঠুক আপন বৈশিষ্ট্যে। এই বিশ্বাস নিয়ে হলুদ পদ্মের বিল থেকে ফিরে আসি।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল