• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের ভিন্ন আচরণ, গবেষকরা কী বলছেন?

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ৪ এপ্রিল ২০২০  

জিবন কেড়ে নেওয়া করোনা ভাইরাস বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২০৪টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বেশ কয়েকটি উন্নত দেশে। শনাক্ত হয়েছে বাংলাদেশেও। তবে দেশে ভাইরাসটির সংক্রমণের প্রবণতা নিয়ে বিশাল পার্থক্য ধরা পড়েছে। পার্থক্য রয়েছে মৃত্যুর হারেও। এসব নিয়ে গবেষকরা বিভিন্ন মত দিচ্ছেন। ভাইরাসটির আচরণ নিয়েও ভাবছেন তারা।

 

এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আইইডিসিআর এর তথ্য মতে দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬১ জন। মারা গেছেন ছয় জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৬ জন।

 

এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। এতে ঘনবসতি, স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সক্ষমতার অভাব এবং সাধারণ মানুষের পরিচ্ছন্নতার অভ্যাসে ঘাটতি- এসব কারণে বাংলাদেশে ভাইরাসটির ব্যাপক সংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু প্রেক্ষাপট ভিন্ন দেখাচ্ছে।

 

এ বিষয়ে ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলছেন, বাংলাদেশের ডাটা অন্যদের সঙ্গে মিলছে না কেন তা নিয়ে আমিও চিন্তিত। আমাদের এখানে ভাইরাসটি ইতালি থেকে এসেছে। সেটি ইতালিতে হ্যাভক তৈরি করলো আর আমাদের এখানে কিছুই করছে না এরকম একটা ব্যাপার। বিষয়টা আমিও বুঝতে পারছি না। তবে উহান থেকে যে ভাইরাসটির উৎপত্তি তা কিন্তু মিউটেশন হয়েছে। কিছু দেশে একই ধরনের সংক্রমণের প্যাটার্ন হয়েছে। আবার অন্য কোথাও একটু ভিন্ন। আমাদের ভাইরাসটি উহান থেকে আসেনি। তিনি আরো বলেন, জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে অনেক দেশে, কিন্তু একটা দেশেই, মাইক্রোকেফালি দেখা দিল। সেটা ব্রাজিলে। এরপর একটা ভাইরাস মালয়েশিয়াতে তৈরি হয়েছে। সেটা হচ্ছে নিপাহ ভাইরাস। যেটা বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালের দিকে এলো এবং বাংলাদেশেই ঘোরাফেরা করছে। ভাইরাসের চরিত্র যথেষ্ট গবেষণা না করে বলা কঠিন।

 

নজরুল ইসলাম আরো বলেন, শুধু ভাইরাস নয়, যিনি ভাইরাসটি বহন করছেন তার কথাও বিবেচনা করতে হবে। 

 

এ কথার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, একটা ভাইরাস আছে সেটা আফ্রিকানদের যখন আক্রান্ত করে তখন তাদের এক ধরনের ক্যান্সার হয়, একটা লিম্ফোমা হয়। সেই ভাইরাসটিই যখন চীনাদের ইনফেক্ট করে- তখন তাদের নেজো-ফেরেঞ্জিয়াল কার্সিনোমা হয়। যারা ইনফেকটেড হয় তাদের জীনগত বিষয়টাও দেখতে হবে। একটা দেশের মানুষজনের জীনগত বৈশিষ্ট্যের উপরেও অনেক সময় রোগের প্রাদুর্ভাবের সম্পর্ক থাকে।

 

অধ্যাপক ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে প্রথম রোগী ৮ মার্চ শনাক্ত হন। এরপর প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সময় (ইনকিউবেশন পিরিয়ড) ১৪ দিন। দুটি ইনকিউবেশন পিরিয়ড শেষ হবে এপ্রিলের পাঁচ তারিখ। এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। পাঁচ তারিখের পর সম্ভবত আমরা বলতে পারবো যে বাংলাদেশে এর আচরণ কেমন।

 

যদিও জনসমাগম এড়িয়ে চলাকে ভাইরাসটি প্রতিরোধের অন্যতম উপায় বলা হচ্ছে। এতে করে নতুন আশঙ্কা তৈরি হয় করোনাভাইরাসটি আরো বেশি ছড়িয়ে পড়ার। 

 

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ হেলথ সায়েন্সেস-এর এপিডোমোলজি বিভাগের প্রধান ড. প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত বলেন, ভাইরাসটির প্রবণতা ভিন্ন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট গবেষণার আগে খুব বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তার মতে, এটা নতুন ভাইরাস। পশ্চিমা বিশ্বেও খুব বেশি তথ্য নেই। শুধু কিছু ধারণার ওপর ভিত্তি করে গবেষণা চলছে। যেমন তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা একটা বিষয় হতে পারে। কিন্তু এ সম্পর্কে কোনো যথাযথ তথ্য নেই। তাই ধারণাগুলো গ্রহণ বা নাকচ কোনটিই করতে পারছি না।

 

ভারতে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয় ৩০ জানুয়ারি। সেখানে এখনো পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। দেশটিতে ২১ দিনের লকডাউন জারি রয়েছে। যা ঘোষণা করার পর কোটি কোটি মানুষ একসঙ্গে শহর ছেড়েছেন। সেখানেও জনসংখ্যার অনুপাতে সংক্রমণ কম দেখা যাচ্ছে।

 

ড. প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত বলেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে শুরু থেকেই সরকারের ব্যাপক সতর্কতা লক্ষ্য করা গেছে। আশা করছি এসব সতর্কতা দেশবাসীর জন্য সুফল বয়ে আনবে।

 

বাংলাদেশে করোনা কেন ভিন্ন আচরণ করছে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের ৫ রকমের মতামত পাওয়া গেছে। তবে আগামী ৭ থেকে ১০দিন গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন।

 

প্রথমত- করোনা সংক্রমিত এলাকা থেকে অভিবাসীরা আসার পর এরইমধ্যে ১৪ দিন অতিবাহিত হয়েছে। করোনা সংক্রমিত হওয়ার জন্য এই ১৪ দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বশেষ ইউরোপ, বিশেষ করে ইতালি থেকে আগতদের মধ্যে যারা হোম কোয়ারেন্টাইন মানেননি, তাদের প্রত্যেকেরই প্রায় ১৪ দিন অতিবাহিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরো ৭ দিন যদি অপেক্ষা করা যায়, তাহলে মোটামুটি একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। সেজন্য এই ১৪ দিনের মধ্যে যেহেতু করোনার ব্যাপক বিস্তৃতি হয়নি। সেজন্য ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে করোনার ঝুঁকি আগের চেয়ে কমে গেছে।

 

দ্বিতীয়ত- বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে করোনার ঝুঁকি কমার কারণ হলো নতুন যারা বিদেশ থেকে আসছেন, তাদেরকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী নামানোর পর থেকেই দেখা যাচ্ছে, কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাটা অত্যন্ত কঠোরভাবে আরোপ করা হচ্ছে। ফলে নতুন করে তারা যে সংক্রমণ ঘটাবেন- এ রকম সম্ভাবনা ক্রমশঃ কমে আসছে।

 

তৃতীয়ত- বিশেষজ্ঞরা যেই কারণটি মনে করছেন তা হলো, এখন পর্যন্ত যেভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে, তাতে আইইডিসিআর মনে করছে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সামাজিক সংক্রমণ খানিকটা হয়েছে। তবে এর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেনি। কারণ মিরপুরের টোলারবাগসহ যে সব জায়গাগুলোতে সামাজিক সংক্রমণ ধরা পড়েছিল সেই জায়গাগুলোকে সঙ্গে সঙ্গে সফলভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যার জন্য সামাজিক সংক্রমণ ততটা বিস্তৃত হয়নি।

 

চতুর্থত- বিশেষজ্ঞদের মতে, এদেশের মানুষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। যার কারণে করোনা বাংলাদেশের মানুষের ওপর খুব বড়সড় আঘাত হানতে পারেনি এবং ব্যাপক বিস্তৃতও হতে পারেনি।

 

পঞ্চমত- বাংলাদেশে উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে করোনার প্রকোপ যেমন বিস্তৃত হয়নি, তেমনি আস্তে আস্তে করোনার বিস্তৃতিও কমছে। কারণ ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনলজির (এমআইটি) সর্বশেষ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, করোনা আক্রান্ত এলাকাগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশই হলো শীতপ্রধান এলাকা। আর মাত্র ১০ শতাংশ হলো উষ্ণ অঞ্চল। যদিও এটি এখনো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু তারপরও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, উষ্ণ এলাকায় করোনাভাইরাস বেশিক্ষণ টিকতে পারছে না। এটি মোটামুটি নিশ্চিত।

 

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেছেন, আগামী সাত দিন গুরুত্বপূর্ণ। এই সাত দিন যদি বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের বিস্তৃতি না ঘটে তাহলে দেশে করোনা মহামারি আকার ধারণ করবে না বলেই মনে করা যায়। 

 

‘তবে আরো কিছুদিন ধরে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে সামাজিক দূরত্ব এবং সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচিগুলো যদি আমরা এড়িয়ে যেতে পারি তাহলে হয়তো আমরা করোনা মহামারি থেকে এ যাত্রায় পরিত্রাণ পেতে পারবো।’

 

চীনের উহানে প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিল ডিসেম্বরের শেষে। জানুয়ারির শেষের দিকে চীনের সব প্রদেশেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, চীনে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত ৮২ হাজারের বেশি রোগী ছিল। চীনের পরে দক্ষিণ কোরিয়ায় মানুষজন বেশ আক্রান্ত হতে থাকে।

 

ইউরোপে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর একটি ইতালি। জন্স হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে জানুয়ারির শেষে ইতালিতে সংক্রমণ শুরুর পর ৬১ দিনে এখনো পর্যন্ত সব মিলিয়ে এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৬৭ দিনে দেড় লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। সবচেয়ে আক্রান্ত অন্যান্য দেশগুলো যেমন স্পেন, ইরান, যুক্তরাজ্য প্রায় সবগুলো দেশেই ভাইরাসটি বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিই দেখা গেছে।

 

করোনা নিয়ে তথ্য প্রদানকারী ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটার এর তথ্য মতে, ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা ৫৩ হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ১০ লাখ ১৬৮ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ জন।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল