• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

‘বকুনি খেলেই কাঁদে’, তবু তরুণী স্ত্রীর বিরহ সহ্য হতনা বিভূতিভূষ

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২৮ এপ্রিল ২০২০  

কল্যাণী ও আমি কত গল্প করি। এক’দিন ও আমার কাপড়ে’র সঙ্গে গিঁট দিয়ে রেখেছি’ল, পাছে আমি পালা’ই। বড় ভালো লা’গে ওকে। রাত্রে কল্যাণী বড় হা’সায়। বলে – ঘুমু’বেন না।

 

ডাই’রিতে লিখছেন বিভূতিভূষণ। তারিখ – ১৪ জা’নুয়ারি, ১৯৪১। বিয়ের দেড়’মাসও পূর্ণ হয়নি তখন। ৪৬ বছরের বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তত’দিনে ‘বুড়ো’ বলে ধরেই নিয়ে’ছেন নিজে’কে। বিয়ে হল রমা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ডাক’নাম কল্যাণী। ১৮ বছ’রের কল্যাণীর সঙ্গে বিভূতিভূষণের বয়’সের ফারাক অনেক। অস’মবয়সী এই বিবাহ নিয়ে বিভূতিভূষণের সংকো’চ ছিল খানিক। কিন্তু কল্যাণী এসবের প’রোয়া করেননি। অটো’গ্রাফ নিতে এসে আলাপ। তারপর ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব। একবছরের মাথায়, বিবাহ।

 

অথচ এর আগে প্রায় ২০ বছর ছন্ন’ছাড়া জীবন কাটিয়েছেন বিভূতিভূষণ। ১৯১৯ সালে প্রথম বিয়ের একবছরের মাথাতেই মারা যান স্ত্রী গৌরী দেবী। দীর্ঘ একাকিত্বের পর, ১৯৪০-এর ৩ ডি’সেম্বর কল্যাণীর সঙ্গে বিবাহ হয় তাঁর।

 

বিয়ের পরে, তাঁর ডাইরিতে বারবার এসেছে কল্যাণীর প্রসঙ্গ। তরুণী ভার্যার প্রেমে বিভূতিভূষণ ডুবে আছেন আকণ্ঠ। ইস্ট’বেঙ্গল স্টোরে গিয়ে ঢাকাই শাড়ি কিনছেন ক’ল্যাণীর জন্য। জন্ম’দিনে উপহার দিচ্ছেন সাবানদানি। তাঁকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন এখানে-সেখানে।

 

কল্যাণীর জন্যে মন কেমন করচে। ওকে ফেলে এসে মোটে ভালো লাগচে না।

 

এমনকি, কল্যাণীকে কোনো কারণে ধমক দিলে, পরে আফশোসও হচ্ছে তাঁর। লিখছেন – ‘রাত্রে কল্যাণীকে বকলুম। ও ফোঁস্‌ ফোস্‌ করে কাঁদ’তে লাগল। ছেলে’মানুষ। বকুনি খেলেই কাঁদে। ভারী মায়া হয়।’

 

তখন প্রতি সপ্তাহে বনগাঁয় শ্বশুর’বাড়িতে যেতেন বিভূতি’ভূষণ। একবার সেখানে স্ত্রী’কে রেখেই কাজের জন্য ফিরে এলেন কল’কাতায়। কিন্তু তাঁর মন ভালো লাগছে না কল্যাণীকে ছাড়া থাকতে। লিখলেন –

 

‘কল্যাণীর জন্যে মন কেমন করচে। ওকে ফেলে এসে মোটে ভালো লাগচে না। ও কেমন হাসার কথা বলে – সর্বদা সে কথা মনে পড়চে। বেশ আনন্দ গি’য়েচে ক’দিন।

কল্যাণী সেদিন বেশ বলেছিল – আপনার লেপখানা আপনি গায়ে দিন – আমার লেপ নে’বেন না। বাবা তো দুখানা লেপ দিয়েচেন।

অথচ সে’দিন শীত নেই। আমার লেপের দরকার নেই। কল্যাণী এ কথা এমন হাসির সুরে বল্লে যে আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি। কি চমৎকার হাসাতে পারে! এ’জন্যে বড় ভালো লাগে ওকে। এমন মজার কথা এক একটা বলে!’

 

তার একদিন পরেই লিখছেন ‘আজ সকালে ঘুম ভেঙে কল্যাণীর কথা মনে হয়ে’চে।’ প্রৌঢ় বিভূতিভূষণ কল্যাণীর বিরহে কাতর। নতুন স্ত্রী-র সব’কিছুই ভালো লাগছে তাঁর। বারবার মনে পড়ছে কল্যাণীর কথা। বিভিন্নজন আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন দম্পতিটিকে। বিভূতিভূষণ খুশি তাতেও।

 

তোকে ক্রমে ক্রমে চিনচি, কল্যাণী! কত ভাগ্যে তোর মতো স্ত্রী পাওয়া যায়। হৃদয় আছে তোর।

 

আরেকদিনের কথা ডাই’রিতে লিখছেন – ‘কল্যাণীকে পত্র লিখলুম সকলের আগে কারণ সারা’রাত স্বপ্নের মধ্যেও ওর কথাই মনে এসেচে।’ আরে’কবার, বনগাঁয় গেছেন বিভূতিভূষণ। সারা’রাত গান শোনালেন কল্যাণী। শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়লেও, হাত ধরে রইলেন বিভূতিভূষণের, ‘পাছে পালিয়ে যাই ভোরের ট্রেনে।’

 

একদিন পর, ফেরার সময় মুখোমুখি হলেন স্ত্রী’র অভিমানের। ‘কল্যাণী বড় ভালোবাসে – ছেলেমানুষ! …দুপুরে ঘুমিয়ে উঠে বিকেলে চলে আ’সবো, কল্যাণীর কি কাণ্ড! কখনো কাঁদে, কখনো রাগ করে। ছেলে’মানুষকে কি করে যে বোঝাই! …সারা ট্রেন কল্যাণীর মুখ মনে পড়’ছিল। কি করবো – আমার হাতে উপায় নেই কিছু।’

 

এমনকি, এক গ্রামে সাহিত্যসভায় গিয়েও তাঁর মন হুহু করে উঠেছিল কল্যাণীর জন্য। বন্ধু শৈলজানন্দ মজুম’দারকে চুপিচুপি বলেছিলেন, ‘ভাই, আ’মার স্ত্রীর জন্যে বড় মন কেমন করচে।’ চিতা জ্বলতে দেখে, বিভূতিভূষণের মনে পড়ে’ছিল স্ত্রী-র কথা। যদি তিনি মারা যান হঠাৎ, কল্যাণীর কী হবে!

 

বিভূতিভূষণের ডাইরি থেকেই পড়ে নেওয়া যাক সেই অপূর্ব অনুভূতি – ‘সেই দিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে অন্ধকারে দূরের একটি নিরীহা প্রেম’ময়ীর কণ্ঠস্বর কেবলই কানে আসে, কান্না পায় যেন। কল্যাণী! আর কি তো’কে দেখতে পাবো? কেন এমন মন হল? মেসে এসেই আগে ঘর খুলে দে’খেছি দোরের পাশে ওর চিঠি এসে পড়ে আছে কিনা। আছে, আছে! ভগবান তোমায় অজস্র ধন্যবাদ। সত্যিই এমন অদ্ভুত মনের অবস্থা আমা’র কেন হল আজ? চিঠিখানা ওর আজ বড় সুন্দর। কতবার পড়লুম যে! তোকে ক্রমে ক্রমে চিনচি, কল্যাণী! কত ভাগ্যে তোর মতো স্ত্রী পাও’য়া যায়। হৃদয় আছে তোর। ভগবানকে আবার ধন্যবাদ দিই যে ওকে পেয়েচি।’

 

ভাই, আমার স্ত্রীর জন্যে বড় মন কেমন করচে।

 

এভাবেই প্রেমে ও বিরহে ভরে আছে বিভূতিভূষণের ডাইরির পাতা। তরুণী স্ত্রী-র প্রতি তাঁর এই সমর্পণ ও উতলা ভাব দেখলে অবাক হতে হয়। দীর্ঘ একাকিত্বের পর কল্যাণী তাঁকে দিয়েছিল শীতল আশ্রয়। আরণ্যকের লেখক সংসারের স্বাদ পেয়েছিলেন কল্যাণীর কাছে এসে। এই দাম্পত্য যে-কোনো প্রেমকাহিনিকে টেক্কা দিতে পারে। ‘সত্যি ও আমাকে বড় ভালোবাসে’ – এই বিশ্বাস আঁকড়ে শান্তি পেয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। বয়সের ফারাক-কে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন তাই।

 

আর কল্যাণী? মাত্র ২৮ বছর বয়সে স্বামীহারা হয়েও আজীবন আঁকড়ে ছিলেন বিভূতিভূষণের স্মৃতি। তিনবছরের শিশুপুত্র তারাদাসকে নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন বাপের বাড়ি। তাঁরও পরে কেটেছে অনেক বছর। বৃদ্ধা কল্যাণী আক্রান্ত হয়েছিলেন অ্যালঝাইমার্সে। ভুলে যাচ্ছিলেন আগেকার অনেক স্মৃতিই। বিবাহ-পরবর্তী দাম্পত্যের কথা কি তখনও উঁকি দিত মস্তিষ্কে? কে জানে!

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল