• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

পিরামিড, মমি ও অভিশাপ

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

পিরামিড, মমি ও অভিশাপ

পিরামিড, মমি ও অভিশাপ

যুগে যুগে মানুষ তার বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখতে নানা অবিশ্বাস্য কাজ করে এসেছে। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের মিশরীয়রা বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর কখনো না কখনো তাদের মৃতদেহে আত্মা ফিরে আসে। কোনোভাবে যদি এই মৃতদেহ নষ্ট হয়ে যায় তবে আত্মাও নষ্ট হয়ে যায়। আত্মা যাতে ফিরে আসতে পারে সেজন্য মৃতদেহকে রাখতে হয় অক্ষত। মৃতদেহকে অক্ষত রাখার এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় মমি। এটি মৃতদেহকে প্রাকৃতিকভাবে ধ্বংস ও ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। মিশরে বিশেষ করে রাজা-রানীদের মৃতদেহ মমি করে রাখা হত। মিশরের ২৬তম রাজার বংশকাল অর্থাৎ ৬৬৪ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে রাজা-রানীদের মমি তৈরির প্রচলন বেড়ে যায়।

মমি শব্দটির উৎস পারস্য শব্দ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে মোম। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পুরানো এই পদ্ধতিতে মৃতদেহকে অক্ষত রাখতে সম্পূর্ণভাবে মোম দিয়ে আবৃত করে নেয়া হত। তাদের এই মমির উপর নিখুঁতভাবে একের পর এক ইট বসিয়ে তৈরি করা হয়েছে পিরামিড। ইতিহাসের পাতায় সপ্তম আশ্চর্যের রহস্যময় নিদর্শন হিসেবে নাম রয়েছে পিরামিডের। এর নির্মাণশৈলী নিয়ে যুগ যুগ ধরে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। পিরামিডের ভিতরের দেয়ালে আঁকা নানা রকমের ছবি, চিত্রলিপিতে লেখা ধর্ম সঙ্গীত আর দেয়ালে খোদাই করা প্রাচীন লিপি উদ্ধার করে এ সম্পর্কে সঠিক খবর জানার চেষ্টা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এরপরও নিশ্চিত হওয়া যায়নি- ঠিক কী কৌশলে তখনকার দিনে সুউচ্চ পিরামিডগুলো তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল।

তবে এতটুকু অবশ্যই জানা গেছে যে, পাথরের সঙ্গে পাথর জোড়া দিয়ে এতই নিঁখুতভাবে এগুলো তৈরি   হত যে, একটি পাথর থেকে আরেকটি পাথরের মাঝে এক চুল পরিমাণ ফাঁক নেই। কারো মতে, নির্মাণাধীন পিরামিডের এক পাশ থেকে মাটি বা পাথরের ঢাল তৈরি করে তার ওপর দিয়ে ভারী পাথর টেনে তুলে পিরামিড বানানো হয়েছে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞই এ মত প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের মতে, পিরামিড যত উঁচু হবে, ঢাল তত প্রশস্ত করতে হবে। এভাবে পিরামিডের চূড়া পর্যন্ত পৌঁছতে ১৩ মাইল লম্বা ঢাল বানাতে হবে, যা অসম্ভব। আবার আরেক মতানুসারে, পিরামিড বানানো হয়েছে ধাপে ধাপে চারপাশ দিয়ে ছোট ছোট ঢাল বানিয়ে। আরেক তথ্য মতে, পিরামিডের চারপাশ মাটি দিয়ে ভরাট করে নির্মাণ কাজ শেষ করে পরে মাটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যদিও এর সবকিছুই ধারণা মাত্র। যার প্রকৃত রহস্য আজও অজানা। এর অভ্যন্তরীণ নকশাও যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

কোনো মরদেহকে মমি করতে প্রথমে সেটিকে ব্যাকটেরিয়ামুক্ত করা হত। পানির উপস্থিতিতেই ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়। সে কারণে মমি করার জন্য মরদেহকে দ্রুত পানিমুক্ত করা হতো, যাতে সেখানে ব্যাকটেরিয়া ভিড়তে না পারে। মমি তৈরি করার পদ্ধতিকে প্রায় দীর্ঘমেয়াদি বলা চলে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুগন্ধি কেমিক্যাল দিয়ে একটি দেহ মমি করতে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ দিন লেগে যেত। প্রথমে রাজার শরীর পাম ওয়াইন ও নীল নদের পানি দিয়ে ধুঁয়ে শরীরের ভিতর থেকে পচনশীল দ্রব্য (যেমনঃ হৃৎপিন্ড, ফুসফুস ইত্যাদি) বের করে ফেলা হত এবং অভ্যন্তরীণ নাড়ি-ভুঁড়িগুলো বের করে ফেলে দেয়া হতো, রয়ে যেত শুধু চামড়া আর হাড়। এরপর ফাঁপা শরীরে পাথর ঢোকানো হত এবং লবণ দ্বারা তাদের ঢেকে দেয়া হত যাতে করে শরীরের অবশিষ্ট পানি বেরিয়ে গিয়ে শরীর শুকিয়ে যায়।

এরপর লিনেন কাপড় দিয়ে তাদের শরীরটিকে পেঁচানো হত। লিনেন কাপড়কে তারা পবিত্র কাপড় মনে করত। এরপরের ধাপে মমির দুই হাতের মাঝে একধরনের রক্ষাকারী মন্ত্র লিখে দেয়া হত। তারা মনে করত যে এই মন্ত্র তাদের রাজাকে খারাপ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করবে। তারপর শরীরকে আবার লিনেন কাপড় দিয়ে মুড়ে বিশেষ ফিতা দিয়ে বেঁধে দেয়া হত। এরপর শেষ ধাপে আবার লিনেনে মুড়ে বুকের উপর ‘আসিরিস’ নামক দেবতার প্রতীক লাগিয়ে দেয়া হত। এভাবে মমি তৈরি করে তাদের একটি বিশেষ শক্ত ও মজবুত বাক্সে রেখে পিরামিডে স্থাপন করা হত। সে যুগে মিশরের রাজারা ছিল ফারাও। খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০০ বছর আগে প্রথম ফারাও হিসেবে সিংহাসনে বসেন রাজা মেনেস। এরপর একে একে ৩২টি বংশ শাসন করেছে মিশরকে। ভ্যালী অব দ্য কিংয়ে রয়েছে কয়েকশ’ সমাধি।

মৃত ফারাও এর পরকালে যাতে কোনো কিছুর অভাব না হয় সেজন্য তাদের সমাধিস্থ করার সময় খাবার দাবার, নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী থেকে শুরু করে যাবতীয় পার্থিব জিনিস, ধন-রত্নও রেখে দেয়া হতো পিরামিডের ভিতরে। যতই রক্ষার ব্যবস্থা করা হত না কেন, এসব ধনরত্ন ডাকাতেরা লুট করে নিয়ে যেত। মিশরীয় ফারাওদের মধ্যে তুতেনখামেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মাত্র নয় বছর বয়সে মিশরের সিংহাসনে বসেন তুতেনখামেন। খুবই অল্প দিনের রাজত্ব শেষে মারা যান তিনি। নিয়মানুযায়ী, তার নামাঙ্কিত পিরামিড তৈরি করে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। সর্বপ্রথম তারই মমি খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯২২ সালের ২৬ নভেম্বর ফারাও তুতেনের মমি আবিষ্কার করেন প্রত্নতাত্ত্বিক হাওয়ার্ড কার্টার ও এ কাজে তার আর্থিক সহায়তাকারী হিসেবে ছিলেন কর্নারভান। সেই সময়টাতে মেটাল ডিটেক্টর ছিলো না, এখনকার মতো উন্নত প্রযুক্তি ছিলো না, পর্যাপ্ত তথ্য ভাণ্ডার অপ্রতুল ছিলো, তারপরেও এ সমাধি আবিষ্কার সম্ভব হয় কার্টারের অসীম প্রচেষ্টায়। এ সময় তার মমিতে নানা ধনরত্ন ও মণিমুক্তা খচিত ছিল।

কোনো এক অজানা কারণে তুতেনখামেনের এই মমি উত্তোলন নিয়ে রয়েছে নানা তর্ক বিতর্ক ও রহস্য। তুতেনখামেনের সমাধি উন্মোচনের আনুষ্ঠানিক তারিখ হিসেবে ঘোষণা করা হয় ২৬ নভেম্বরকে। ২৬ নভেম্বর, হাওয়ার্ড কার্টার, লর্ড কার্নার্ভনসহ আরও ২২ জন গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি নিয়ে সমাধির দরজার কাছে যান। ফটকটির উপর পার্শ্বের বাম কোণায় একটি ছোট ফাটল তৈরি করে ভেতরে উঁকি দিলে কার্টার দেখতে পেলেন স্বর্ণ ও মণিমুক্তার অসংখ্য আসবাব ও কীর্তি! এতে অনেক পরিদর্শকের সঙ্গে লর্ড কার্নার্ভনও ছিলেন। এর কয়েকদিন পর শেভ করার সময় কেটে গিয়ে ইনফেকশন হয়ে তার প্রচন্ড জ্বর হয় ও সারা শরীরে ছিদ্র ছিদ্র হয়ে যায়। ঠিক যেমনটি ছিল তুতেনের মমিতে। মারাত্মক জ্বরে ভুগে লর্ডা কার্নার্ভন ওই বছর ৫ এপ্রিল রাত ১ টায় কায়রোতে মৃত্যুবরণ করেন। কোনো এক অজানা কারণে তার ঠিক মৃত্যুর সময়ে পুরো কায়রো জুড়ে বিদ্যুৎ চলে যায়।

এসব কারণে তার মৃত্যু ও তুতেনের মমি নিয়ে অভিশাপের গল্প অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, একইদিনে লন্ডনে তার কুকুর ‘সুশি’ ভোর ৪ টায় মারা যায়, এর সঙ্গে কার্নার্ভনের মৃত্যুকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক ভৌতিক গল্প ছড়াতে থাকে সংবাদপত্রগুলো। কার্নার্ভনের মৃত্যুর পর কায়রোতে মানসিক ভারসাম্যহীনতা ছড়িয়ে যায় বলে আরেক অভিশাপের গল্প রটে যায়। তখন কায়রোতে মানসিক ভারসাম্যহীনতা রোগটি স্বাভাবিকভাবেই বিরাজমান ছিলো। সেই বছরই ২৬ সেপ্টেম্বর কার্নার্ভনের সৎভাই কর্ণেল অ্যাব্রে হারবার্ট এর অন্ধত্ব যেন গুজবের পালে আরো হাওয়া লাগায়। চমৎকার গল্পগুলোর ভেতর অন্যতম হলো ১৯২৮ সালে কার্টারের এক সহযোগীর মৃত্যু। যদিও পরে পরীক্ষা করে দেখা যায় তিনি আর্সেনিক বিষ্ক্রিয়ায় ভুগছিলেন। আরো ডজনখানেক মৃত্যু ও দুর্ঘটনাকে সমাধি আবিষ্কারের সঙ্গে পেঁচিয়ে সেই সময়টাতে প্রচুর গল্প ও রহস্য প্রচলিত হয়, যেগুলো এখনো বর্তমান। অথচ, তুতেনখামেনের শবাধার আবিষ্কারের পর প্রথম ১০ বছরে মাত্র ২ জন পরিদর্শনকারীর মৃত্যু হয়, এবং প্রায় সকলের মৃত্যুই ছিলো বেশ স্বাভাবিক।

মমি নিয়ে যত রহস্য তার এখানেই শেষ নয়। খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতকে মিশরে আমেনরা নামে এক রাজকুমারী মারা যান। তাকে যথাযথ নিয়মে মমি করে সমাধিস্থ করে রাখা হয়। অনেক বছর পর ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে তার মমিটি কেনার জন্য চারজন ইংরেজ মিসরে আসেন এবং তারা রাজকুমারী আমেনরার মমিটি ক্রয় করেন। এ জন্য তাদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মমিটি কিনে নিয়ে যাওয়ার সময় চারজনের একজন মরুভূমির ঝড়ের কবলে পড়ে মারা যান। তারপর ইংল্যান্ডে ফেরার পর তাদের একজন দেখেন তার সব সম্পত্তি কেউ একজন আত্মসাৎ করেছে। আর একজন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হঠাৎ তার চাকরি চলে যায়। মমিটির পরবর্তী স্থান হয় ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। কিন্তু যে একবার মমিটি স্পর্শ করেছে তারই কিছু না কিছু অঘটন ঘটেছে। এমনকি এক দর্শনার্থী কাপড় দিয়ে একবার মমিটির মুখ পরিষ্কার করেছিলেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে তার ছেলে মারা যায়। আর একবার এক ফটোসাংবাদিক মমিটির ছবি তুলেছিলেন। ছবিটি ডেভেলপ করে দেখেন, রাজকুমারীর মুখের বদলে এক ভয়ঙ্কর বীভৎস ও বিকৃত একটি মুখ। সেই রাতেই তিনি আত্মহত্যা করেন।

এরপর মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ মমিটি প্রদর্শন বন্ধ করে দেয় এবং এটি স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। তার পরের দিনই কর্মকর্তারা দেখেন তাদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার লাশ পড়ে আছে টেবিলের ওপর। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। এত কিছুর পরও এক মার্কিন পর্যটক মমিটি ক্রয় করেন এবং নিজের দেশে ফেরার জন্য নিউইয়র্কগামী এক জাহাজের কেবিন ভাড়া নেন। আর এ যাত্রাই ছিল জাহাজটির প্রথম এবং শেষ যাত্রা। কারণ যাত্রাপথেই জাহাজটি ডুবে যায়। আর সেই জাহাজটি ছিল বিখ্যাত টাইটানিক। তিন হাজার বছরে বানানো হয় প্রায় ৭০ কোটি মমি। এর মাঝে বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে যায় যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ও সমাধি ডাকাতদের কারণে। যেসব মমিগুলো অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়, সেগুলো বেশিরভাগই ছিল ফারাওদের। মিশরে যে শুধু মানুষের মমি পাওয়া গিয়েছিল তা নয় বরং অনেক পশুপাখির মমিও পাওয়া যায়।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল