• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

দেড় কিলোমিটার সড়ক বানালেন নাগরপুরের কৃষক ছইনুদ্দিন

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২ মার্চ ২০২০  

গ্রামে চলাচলের সড়ক নেই। ক্ষেতের আইল দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। বর্ষায় দুর্ভোগের সীমা থাকে না। মানুষের যাতায়াতের এ কষ্ট ভাবিয়ে তুলে এক উদ্যমী কৃষককে। একদিন কোদাল হাতে নেমে পড়েন সড়ক তৈরির কাজে। প্রায় তিন মাসের পরিশ্রমে দেড় কিলোমিটার সড়ক তৈরি করে ফেলেন। পুরো গ্রামের মানুষ এখন যাতায়াতের সুবিধা পাচ্ছেন এই সড়কের কারণে। নিজ উদ্যোগে সড়ক তৈরি করে মানুষের দুর্ভোগ লাঘবকারী ব্যক্তিটির নাম ছইনুদ্দিন। তিনি টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার চকগগাধর গ্রামের মাইন উদ্দিনের ছেলে।

৪৬ বছর বয়সী ছইনুদ্দিনকে বছর তিনেক আগে তার বাবা গ্রামের পশ্চিম অংশে একটি বাড়ি ও পুকুর করে দেন। সে বাড়িতেই স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে ছইনুদ্দিনের বসবাস। কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

গ্রামের ভেতর দিয়ে কোনো সড়ক নেই। জমির আইল ধরে যাতায়াত করতে মানুষের খুব দুর্ভোগ। ভারী কোনো জিনিস রিকশা বা ভ্যানযোগে আনা নেয়া করা যায় না। মাথায় করে নিতে হয়। এসব বিষয় ভাবিয়ে তুলে ছইনুদ্দিনকে।

ছইনুদ্দিন জানান, তখন তিনি দেখেন দক্ষিণ দিকে ধুনাইল পাকা সড়ক থেকে গ্রামের ঈদগাহ হয়ে মসজিদ পর্যন্ত সড়ক হলে মানুষের আর দুর্ভোগ থাকে না। তাই দেড়ি না করে নিজেই লেগে পড়েন সড়ক তৈরিতে। প্রথমে নিজেদের জমির অংশে মাটি কেটে সড়ক তৈরি করেন। পরে যান অন্যদের কাছে। তাদের বুঝিয়ে জমি তাদের জমির উপর দিয়ে সড়ক তৈরি করেন। অনেকেই বুঝতে চাইতো না। তাদের হাতে পায়ে পর্যন্ত ধরতে হয়েছে ছইনুদ্দিনকে। 

২০১৮ সালের ডিসেম্বরের দিকে সড়ক তৈরির কাজ শুরু করেন ছইনুদ্দিন। মাস খানেক একা একাই কাজ করতে থাকেন। পরে পুরোদমে কাজ শুরু করেন। নিজের জমিতে কৃষি কাজ করে যে সময়টুকু পেতেন তার সবটুকুই কাজে লাগাতেন সড়ক নির্মাণে। একসময় তার স্ত্রী ও অপর তিন ভাইও সড়ক নির্মাণের কাজে সাহায্য করেছেন।

চকগগাধর গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভাদ্র ইউপির ধুনাইল পাকা সড়ক থেকে একটি খাল পার হয়ে একটি কাঁচা রাস্তা চলে গেছে উত্তরদিকে ধুবুরিয়া ইউপির চকগগাধর গ্রামের ভেতরে ঢুকেছে। স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন এটি ছইনুদ্দিনের তৈরি করা সড়ক। প্রায় দেড় কিলোমিটার সড়কটি দেড়ফুট থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ছয়ফুট পর্যন্ত উচ্চতা। প্রশস্ততা ছয় থেকে আটফুট হবে। গ্রামের মানুষ যাতায়াত করছেন সড়কটি ধরে। এ গ্রামের মুরগি খামারের মালিক আব্দুল গণি জানান, মাত্র এক বছর আগেও এ গ্রামে সড়ক ছিল না। মানুষের যাতায়াতে খুব কষ্ট হতো। ছইনুদ্দিন সড়ক তৈরি করে মানুষের সে কষ্ট দূর করেছে।

সোলায়মান হোসেন নামক গ্রামের অপর বাসিন্দা জানান, আগে এ গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে চাঙ্গারিতে তুলে বড় সড়ক পর্যন্ত নিতে হতো। এখন ছইনুদ্দিন সড়ক নির্মাণ করায় গ্রামে ভ্যানগাড়ি আসতে পারে। রোগী নিতে কোনো অসুবিধা হয় না।

একই কথা জানালেন গৃহবধূ লিমা আক্তার। তিনি জানান, বাড়িতে কোনো আসবাবপত্র আনতে কুলি দিয়ে মাথায় করে আনতে হতো। মানুষ বাড়িঘর করতে নির্মাণ সামগ্রীও আনতে হতো কুলি দিয়ে। এতে ব্যয় অনেক বেড়ে যেতো। এখন খুব সহজেই আনা যায়। এটা ছাইনুদ্দিনের অবদান।

এ গ্রামের বৃদ্ধা নজরা খাতুন বলেন, ‘ছইনুদ্দিন সড়ক বানাইয়া মানুষের সুবিধা কইরা দিছে, আল্লাহ তারে সুখ শান্তি দিক এই দোয়া করি।’


ছইনুদ্দিনের তৈরি সড়ক
ছইনুদ্দিনের বাড়ি গিয়ে কথা হয় তার স্ত্রী লাকি আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, ছইনুদ্দিন যখন সড়কের কাজ শুরু করে মানুষ তাকে পাগল বলতো। কিন্তু সড়কের কাজ কিছুটা হওয়ার পর গ্রামের মানুষের বিশ্বাস আসে যে এটা পাগলামি না। ছইনুদ্দিন ঠিকই সড়ক করবে। তিনি জমিতে কাজ করে এসেই সড়ক তৈরির কাজে লেগে যেতেন। রাত ১০টা ১১টা পর্যন্ত মাটি কেটে সড়কে ফেলতেন। কোনো কোনো দিন সারারাতও কাজ করতেন। তাকে লাকি আক্তার নিজে এবং তার (ছইনুদ্দিন) ভাই আশরাফ, মনিরুজ্জামান, গণি মিয়া এসে সাহায্য করতেন।

ছইনুদ্দিনের মা মেহেরা খাতুন জানান, তার ছেলের মানুষের জন্য সড়ক করে দিয়েছেন এজন্য তিনি গর্বিত।

গত বছর এপ্রিল মাসে সড়কটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রামবাসী উদ্বোধন করেন। এ সময় অতিথি হয়ে এসেছিলেন এ ইউপির সন্তান ব্যবসায়ী এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকিরুল ইসলাম। তিনি ছইনুদ্দিনের সড়ক দেখে খুশি হয়ে এর উন্নয়নের জন্য ৫০ হাজার টাকা অনুদানও দিয়েছেন। সে টাকা দিয়ে সড়ক উন্নয়ন করা হয়েছে।

ছইনুদ্দিন বলেন, সড়কের জন্য গ্রামের মানুষ অনেকের কাছে গেছে। কিন্তু কেউ সড়ক করে দেয়নি। তাই নিজেই উদ্যোগী হয়ে সড়ক তৈরি করেছেন। কিন্তু এ সড়ক আরো উঁচু এবং পাকা করা প্রয়োজন। তা না হলে বর্ষায় পানির নিচে তলিয়ে ভেঙে যাবে।

ধুবুরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মতিউর রহমান জানান, ছইনুদ্দিন একজন সাধারণ মানুষ হয়ে অসাধারণ কাজ করেছেন। তার কারণেই চকগগাধর গ্রামের মানুষ একটি সড়ক পেয়েছে। তার এ সড়কের আরো উন্নয়ন করার উদ্যোগ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল