• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

এমপি ছোট মনিরের পরিবর্তিত যাত্রা

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

‘নলেজ ইজ পাওয়ার’ এ বহুল প্রবচনটি প্রায়ই মিলেনা। বিশেষ করে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে এটি ভোতা অস্ত্র বলেই পরিগণিত হয়। তৈলবচন, স্তুুতি, চাটুকারিতা, অতিশয়োক্তি যদি রাজনীতির সদর হয়, তবে অন্দর হলো প্রতিহিংসা, লুন্ঠনবৃত্তি আর পরনিন্দা। তবে আমরা রাজনীতির অন্দর-বাহির নিয়ে যতো সমালোচনাই করিনা কেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় চালকের আসনে বসা রাজনীতিকদের অবদান অস্বীকার করার জোঁ নেই। দেশ বা সমাজের উন্নয়ন, গতিশীলতা অথবা স্থিতিস্থাপকতা এদের দ্বারাই বহুলাংশে নির্ণিত বা পরিচালিত হয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যও ছিল তেমনটি।

‘জ্ঞানই শক্তি’ কথাটি সার্বজনীন হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা ক্ষমতার অপব্যবহারের রাজনীতি। এর বিভীষিকাময় দিকটি যদি রাজনীতিকরা সম্যক উপলদ্ধি করতে পারেন, তবেই সুজন দ্বারা কুজনরা শাসিত হবে। নইলে কুজনরা সুজনদের মাথায় পেত্নীরুপে বসে। নিরীহ নাগরিকদের পিন্ডি চটকাবে।


 
এবার প্রসঙ্গে আসি, টাঙ্গাইলের গোপালপুরের রাজনীতি এবং বর্তমান এমপি ছোট মনির সম্পর্কে। কয়েক দশক ধরে সন্ত্রাসের জনপদ হিসাবে গোপালপুরের কুখ্যাতি ছিল। এখনো গোপালপুরের মানুষ কারণে অকারণে মারামারি ও সংঘাত খুব পছন্দ করেন। প্রবাদ রয়েছে, গোপালপুরের লোকজন কথা কম বলেন, মারামারি বেশি করেন। কথার আগে হাত চালাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

প্রায়শঃ দেখা যায়, এখানকার রাজনীতিকরা অপজিশন শক্তিকে মাঠে না পেলে গোকূলের ষাড়ের মতো নিজের দল বা মতাদর্শের মানুষকে গুঁতাতে পছন্দ করেন। এর ঐতিহাসিক অনেক কারণের একটি এখানকার আদি রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় শতাব্দী প্রাচীন এ থানা শহরের শতকরা নিরানব্বই ভাগই ছিল পাকিস্তানপন্থী। এ শহরে পড়ালেখা এবং চারদশকের সাংবাদিকতার সুবাদে রাজনীতির অলিগলি থেকে কানাগলি সবই আমার মুখস্ত।

যাই হোক, দেশ স্বাধীন হবার পর শহরের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অংশের মানুষরা জাসদ, ন্যাপ বা কমুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কেউ কেউ ভেজা বেড়ালের মতো খুঁপচিতে চুপসে ছিলেন। পঁচাত্তরে বিয়োগান্তক ঘটনার পর তারা আওয়ামী বিরোধী রাজনীতি জোরদার করেন। বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর এরা সবাই তাতে যোগ দেন। কথাটা যতোই অপ্রিয় হোক না কেন, এরাই ছিলেন বা আছেন বিএনপির প্রাণশক্তি হয়ে। এখনো তাদের উত্তরসূরিরা বিএনপিকে শক্তভাবে হোল্ড করে থাকেন। গোপালপুর শহরে এখনো এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।


 
কিন্তু গোপালপুরে জাসদ খুনখারাপী শুরু করেছিল। জাসদ তথা গণবাহিনীর হাতে খুন হন আওয়ামীলীগ কর্মী নন্দনপুরের মুসা মিয়া, হেমনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লাল খাঁন, উপজেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক এবং মির্জাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হায়দার আলীসহ ৬জন। গণবাহিনীর ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন তদানিন্তন থানা আওয়ামীলীগ সভাপতি আমজাদ হোসেন ঢাল্লা মিয়া।

নব্বয়ের দশকে গনবাহিনীর মুল নেতা সূতির রফিকুল ইসলাম হুমায়ুন জাপার সাথে লিঁয়াজো করে মাঠ দখল করেন। গনবাহিনীর অপর নেতা হেমনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রয়াত সোহরাব হোসেন বিএনপিতে যোগ দেন। অপর জাসদ নেতা এডভোকেট কেএম আব্দুস সালাম আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তখন জাসদের রাজনীতির রুপান্তর ত্রৈমাত্রিকতায় রুপ নেয়।

জাসদ ও গণবাহিনী গোপালপুরে যে খুনখারাপী ও সন্ত্রাসের রাজনীতি শুরু করেছিল সেটিকে আর পিছে তাকাতে হয়নি। এরশাদ আমলেও হিংসাবিদ্বেষ অব্যাহত ছিল। নগদাশিমলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, প্রবীন রাজনীতিবিদ এম হোসেন আলীসহ বহুলীগ নেতা বহুবার জাপা নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হয়েছেন।


 
তবে গোপালপুরে মোটা দাগে সন্ত্রাস হয় ২০০১ সালে বিএনপি জোট সরকারের সময়। বিএনপি এবং জাসদ থেকে বিএনপিতে নবাগতদের হাতে আওয়ামী লীগ কর্মীদের শত শত বাসাবাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়। শত শত লীগ নেতাকর্মী এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন। এ সময় খুন হন ধোপাকান্দির যুবলীগ নেতা আবু সাঈদ। আর ও কয়েক বছর পর ছাত্রলীগ নেতা ইমরান।

ইতিহাস ও পরিসংখ্যান বলে, গোপালপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই মোটা দাগে খুন হয়েছেন। তুলনামূলকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। হিংসা প্রতিহিংসাকে জন্ম দেয়। আর এটি একবার শুরু হলে সহজে তিরোহিত হয়না। গোপালপুরের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন তা বিদ্যমান ছিল। এখনো কেউ কেউ তুষের আগুনের মতো তা পুষে রেখেছেন।

টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হবার পর ছোট মনির জিঘাংসামূলক রাজনীতিকে গোপালপুর থেকে বিতাড়নের ঘোষণা দেন। মিডিয়া কর্মীদের নিয়ে তিনি পৌরশহরের বিএনপি অধ্যুষিত মহল্লার ডোর-টু-ডোর রজনীগন্ধা নিয়ে হাজির হন। তিনি ঘোষণা দেন, রাজনীতি হবে প্রতিদ্বন্ধিতামূলক, প্রতিযোগিতামূলক। কিন্তু শত্রুতামূলক নয়।


 
এমপি ছোট মনিরের এ সাধু উদ্যোগ কতোটা অভারকাম হয়েছে, সাদামাটা চোখে প্রক্ষেপন ছাড়াও দূরদৃষ্টি নিয়ে তা নিরীক্ষণ বা অনুভব করার অন্তিম সময় এখনো আসেনি। তবে তার সাহসী ঘোষণা শত্রুমিত্র সবাইকে পুলকিত করেছে। দল ক্ষমতায় আসলে সরকারি দলে সব সময় সুবিধাবাদী, মোসাহেব ও লুটেরা শ্রেণী ভিড় জমায়। ত্যাগীরা তখন দুরে যেতে বাধ্য হয়। পেটি বুর্জোয়া রজনৈতিক দল বা সংগঠনে এটি স্বাভাবিক।

আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারি দল। তাদের হাতেই এসেছে দেশের স্বাধীনতা। তাদের কাছে মানুষের চাওয়াপাওয়াটাও বেশি। কিন্তু সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ আর যুবলীগ নিয়ে সারাদেশে এন্তার অভিযোগ শোনা যায়। কেউ কেউ বলে থাকেন মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর দেশে যতো অর্জন তার অনেকটাই উঁইপোকার মতো সাবাড় করেন এ সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী। অভিযোগের সত্যাসত্য থাক বা না থাক, এদুটো সংগঠন মূল দলের ভাবমূর্তি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সফলতাকে সামনে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের তৃণমূলের অধিকাংশ নেতাকর্মী আজ খাঁইখাঁই ছাড়া কিছুই বুঝতে চাননা। অধিকাংশ নেতাকর্মীর দলের নীতি আদর্শ সম্পর্কে কোনো ধারনাই রাখেন না। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি অথবা বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শের বেসিক জিনিস তাদের অনেকের অজানা।

একটা সময় ছিল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা প্রচুর বইপুস্তক পড়তেন। পত্রপত্রিকা ঘাটতেন। এখন দিন পাল্টেছে। কম শিক্ষিত, বেয়াদব, ছোটজাত, মাদকাসক্ত, মোসাহেবরা তৃণমূলের অধিকাংশ নেতা, পাতিনেতা। মুজিব কোট গায়ে জড়িয়ে এরা হাওয়ার বেগে চলেন। দলের নীতি আদর্শের বালাই না থাকলেও এরা স্বঘোষিত নেতা। এরা যেমন দল বা এমপির ভাবমূর্তি ক্ষুন্নে ভূমিকা রাখেন, তেমনি প্রশাসন ও সাধারন মানুষকে অনুক্ষণ যন্ত্রনা দিয়ে বেড়ান।

আশার কথা এমপি ছোট মনির ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টাতে তাগিদ দিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) মহান শহিদ দিবসে তার বই বিতরণ কর্মসূচি সকলকে মুগ্ধ করেছে। গোপালপুর কলেজ মাঠে আয়োজিত আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে তিনি একাধিক গ্রন্থ উপহার দেন। বিতরণকৃত বইয়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ছাড়াও “বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইটি ও রয়েছে।


 
এ সময়ে তিনি মিডিয়া কর্মীদের বলেন, অস্ত্র নয়, নেতাকর্মীদের হাতে বই তুলে দিতে চাই। ওরা পড়ুক জানুক, শিখুক। জানলে, পড়লে, শিখলে মনের প্রসারতা বাড়বে। তখন ওরা সঠিক রাজনীতি করতে পারবে। মুজিব বর্ষে ওরা প্রকৃত মুজিব সেনা হয়ে উঠুক সে লক্ষেই তিনি তাদের হাতে বইপুস্তক তুলে দিচ্ছেন।

এমপি মনির গত সংসদ নির্বাচনের আগে মাঠে-ময়দানে একটি নতুন শ্লোগান নিয়ে ভোটারের সামনে হাজির হয়েছিলেন। সেটি ছিল, “পরিবর্তন আনবেন, পরিবর্তন আসবে।” নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বিরোধী শিবিরের বাসাবাড়িতে ফুলের পাঁপড়ী নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। প্রতিহিংসাকে তিনি পুস্পার্গ দিয়ে মুঁছে দিতে চেয়েছেন। সেই সপ্রংশ উদ্যোগ গোপালপুরকে সহনশীলতার নিক্তিতে অনেকখানি সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে বলে অনেকের ধারনা।

নেতাকর্মীদের হাতে বইপুস্তক তুলে দেয়া আরো একটি অভিনব উদ্যোগ বলে অনেকেই মনে করেন। এটি জুতসইভাবে সফল হলে গোপালপুরে পরিবর্তনের নতুন ধারা সূচিত হতে পারে।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল