• মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

আজ ২৫ মার্চ, বাঙালি নিধন মহাযজ্ঞের কালো রাত্রী

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২৫ মার্চ ২০২১  

আজ সেই ভয়াল ২৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীল-নকসা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালীদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত ও নিকৃষ্টতম গণহত্যা শুরু করে।

এটি ছিল একটি পুর্বপরিকল্পিত গনহত্যা । একটি জাতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করা ও তাদের মনোবলকে সম্পুর্ণভাবে ভেঙ্গে ফেলাই ছিল এই সামরিক অভিযানের মূল লক্ষ্য।

একাত্তেরর ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু একটি রাতের হত্যাকান্ডই ছিল না, এটা ছিল মূলতঃ বিশ্ব সভ্যতার জন্য এক কলংকজনক জঘন্যতম গণহত্যার সূচনা মাত্র।


২০১৭ সাল থেকে একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার দিনটি জাতীয় ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে দিবসটি জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। 

২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। অক্সফোর্ড ডিকশনারী অনুযায়ী গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদিন সংসদে বলেন, ‘জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ গ্রহণ করে। ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বরকে ‘জেনোসাইড ডে’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। কাজেই আমাদের কাছে সেই সুযোগ রয়েছে, জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী আমরা ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।’

সংসদ কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ বিধিতে প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনা শেষে সংসদে তা সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব করলে সংসদ তা পাস করে। পরে ২০১৭ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভার বৈঠকে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা এবং জাতীয় ও আর্ন্তজাতিকভাবে দিবসটি পালনের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। দিবসটিকে ‘ক’ শ্রেণীভুক্ত দিবস অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব মন্ত্রীসভায় অনুমোদন করা হয় ।

অস্ট্রেলিয়ার “সিডনি মর্নিং হেরাল্ড” পত্রিকার ভাষ্যমতে শুধুমাত্র পঁচিশে মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। পরবর্তী নয় মাসে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্যে ৩০ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পূর্ণতা দিয়েছিল সেই বর্বর ইতিহাসকে।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মাচর্ রাত সর্ম্পকে লিখেছেন, ‘সে রাতে ৭ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার হলো আরো ৩ হাজার লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক- শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’

পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তনের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ব চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়, “১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশী মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।”

পশ্চিম পাকিস্তানীরা চেয়েছিল শুধু এই মাটি অর্থাৎ এই ভুখন্ডটি । এদেশের মানুষকে তারা চায়নি । ২৩ বছরের শোষন বঞ্চনার থেকে মুক্তি পেতে বাঙ্গালী জাগ্রত হয়ে উঠেছিল ।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মানুষ জেগে উঠেছিল । ৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আওয়ামীলীগ কে ম্যান্ডেট দিয়েছিল ।পশ্চিমা সামরিক জান্তা কোনদিন চায়নি যে বাঙ্গালীরা ক্ষমতা পাক । বাঙ্গালীরা পাকিস্তান শাসন করুক এটা তারা চায়নি । তাই তারা পুর্বপরিকল্পনা মত কৌশল করে নিরীহ বাঙ্গালীদের উপর প্রতিশোধমূলক গনহত্যা শুরু করে । সে এমন এক বিভীষিকাময় রাত যার বর্ননা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না । আজো বাঙ্গালী শিউরে উঠে সেই কালোরাতের কথা মনে করে ।ধারনা করা হয় সামরিক অভিযান শুরুর প্রথম পর্যায়েই প্রায় ১০ নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করা হয় এবং সারারাত ধরে প্রায় একলক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়।পাকিস্তানী সৈন্যরা রাস্তায় নেমে যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে । ঢাকা ও আশেপাশের অঞ্চলে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু করে । সমগ্র বাংলাদেশকে তারা এক শ্মশানভুমিতে পরিনত করেছিল । জানা যায় রাত ১১ টার পরেই অভিযান শুরু হয়েছিল । পরিকল্পনা ছিল যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট নামক এ অভিযানটি অনুমোদন দেওয়ার পরে পাকিস্তানি জেনারেলরা বাংলাদেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে গিয়ে পাঞ্জাবী সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ করে। তারা বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে পাঠিয়ে দিতে চেষ্টা করে যাতে তারা পাল্টা প্রতিরোধ না করতে পারে ।পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন এবং করাচীতে তার বিমান অবতরনের পরেই জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয় । মূল পরিকল্পনা ছিল প্রথমে কারফিউ জারী করে টেলিফোন টেলিগ্রাফ বন্ধ করা,রেডিও টেলিভিশন বন্ধ করা,ঢাকা শহর কে বিচ্ছিন্ন করে রাখা, অভিযান চলাকালে বঙ্গবন্ধু সহ ১৫ জন বড় আওয়ামীলীগ নেতাকে গ্রেফতার করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ,পিলখান ইপিআর হেডকোয়াটার,রাজারবাগ পুলিশলাইন দখল করে সবাই নিরস্ত্র করা ,যেসব স্থাপনায় বাংলাদেশের পতাকা দেখা যাবে তা নষ্ট করে ফেলা এবং হিন্দু অধ্যষিত এলাকায় হামলা করে হিন্দুদের হত্যা করা । প্রথমেই ২২ বালুচ ও ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ট্যাঙ্ক কামান সহ ভারী অস্ত্র নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পিলখানায় আক্রমন চালায় । তারা ইকবাল হল এবং জগন্নাথ হলে নির্বিচারে ছাত্রদের হত্যা করে । বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতি শিক্ষক অধ্যাপক ডঃ জিসি দেব,ডঃ মনিরুজ্জামান,অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা সহ অনেক শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে ।রাত সাড়ে এগারোটার দিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানীরা হামলা চালালে এখানেই বাঙ্গালী পুলিশরা তাদের প্রথম প্রতিরোধ করে এবং প্রায় সারা রাত যুদ্ধ করে । এখানে প্রায় ৩০০ বাঙ্গালী পুলিশ শহীদ হয় । এরপর পিলখানার ইপিআর হেডকোয়াটারে হামলা চালিয়ে সব বাঙ্গালী জওয়ানদের হত্যা করা হয় ।পুরোনো ঢাকায় প্রায় ৭০০ মানুষকে রাতেই হত্যা করা হয়। 

সারা রাতে ঢাকা এক ধ্বংসস্তপে পরিনত হয়। চারদিকে শুধু পোড়া ঘরবাড়ি আর লাশের পাহাড় যা শকুন আর কুকুরের খাবারে পরিনত হয়েছিল । এত বড় আঘাত হানার পরেও বীর বাঙ্গালীরা যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ চুড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান।

সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আভাস পেয়ে বঙ্গবন্ধু রাত সাড়ে ১২ টায় তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন । এই ঘোষনা তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে ইপিআরের মাধ্যমে প্রেরণ করেন । তিনি বলেন “শেষ সৈন্যটিকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সবাইকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে”।

বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালীরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।  

তাইতো কবি তার কবিতায় বলেছেন,

২৫ শে মার্চ কালো রাত
চারদিকে চিৎকার আর আর্তনাদ
লাশের স্থুপ,আর উত্তেজিত
পৈশাচিক হানাদার,
২৫শে মার্চ কালো রাত।

ঘুমন্ত বাঙ্গালীর প্রান কেড়ে নেই
পাকিস্তানি হানাদার
মানুষ খেকু শাশক গোষ্ঠি
পাকিস্তানি সৈরাচার,
২৫শে মার্চ কালো রাত।

বেঈমান আল বদর,আল সামস্,রাজাকার
জাতিকে দিয়েছিল উপহার
রক্তপিপাশু জানোয়ার,
২৫শে মার্চ কালো রাত।

গ্রামগন্জ্ঞ আর লোকালয়,
পুড়ে হচ্ছে চারখার
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে দোকানপাট,
লোহা লঙ্করের স্তুপ আর কাঠ
২৫শে মার্চ কালো রাত।

হরন করেছে মা বোনের ইজ্জত
অত্যাচারী পাকিস্তান,
তবুও থামেনি অত্যাচারী,
মানু্ষ খেকু পাকিস্তান
২৫শে মার্চ কালো রাত।

জাতি পঙ্গু করে দেয়
পাকিস্তানি সরকার
২৫শে মার্চ কালো রাত।

চারদিকে চিৎকার আর আর্তনাদ
লাশের স্তুপ আর উত্তেজিত
পৈশাচিক হানাদার
২৫শে মার্চ কালো রাত।
 

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল