• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

৩২ প্রতিষ্ঠানের ‘রাজত্ব’ ভাঙতে আরও ২৩ প্রতিষ্ঠান

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ৩০ এপ্রিল ২০২৩  

চট্টগ্রাম বন্দরে আসা পণ্যের ৭০ শতাংশই ওঠানামা করে বহির্নোঙরে। বড় জাহাজ থেকে ছোট লাইটার জাহাজে পণ্য খালাসের এই কাজটি সম্পন্ন করতে বছরে লেনদেন হয় হাজার কোটি টাকা। নির্ধারিত ফি নিয়ে এই কাজটি এতদিন করছিল বন্দরের তালিকাভুক্ত ৩২টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর। দীর্ঘদিন ধরে এই কাজটি করতে গিয়ে এখানে সিন্ডিকেট করে তারা মনোপলি ব্যবসা করছে বলে অভিযোগ ওঠে। যদিও আগে থেকে কাজ করতে থাকা অপারেটররা এসব অভিযোগ স্বীকার করেনি। নতুন অপারেটর নিয়োগের বিরোধিতাও করে আসছে তারা।

পাল্টাপাল্টি এমন অবস্থানের মধ্যেই ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে লাইসেন্স দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এটি নিয়ে এখন মুখোমুখি অবস্থানে বন্দর ও শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন। বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের কাজ বন্ধ করে কর্মবিরতিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বর্তমান অপারেটররা। অন্যদিকে দ্রুততম সময়ে নতুন অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর বলছে নতুন অপারেটর নিয়োগ হলে প্রতিযোগিতা বাড়বে। কমবে পণ্য পরিবহন ব্যয়। সাশ্রয় হবে সময়ও।


ব্যবসায়ীরা চাচ্ছেন পাল্টাপাল্টি অবস্থায় না গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হোক। ধর্মঘট করলে বন্দরে জাহাজজট তৈরি হবে। পণ্য নিয়ে জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় বেড়ে যাবে। পরিবহন ব্যয় বাড়বে। বিদেশে ক্ষুণ্ন হবে দেশের সুনামও।

চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম সমকালকে বলেন, ‘সময়ের হাত ধরে নৌবাণিজ্য ক্রমশ বাড়ছে। ১০ বছর আগের তুলনায় এখন দ্বিগুণ পণ্য হ্যান্ডল করছে চট্টগ্রাম বন্দর। এই বাস্তবতা মেনে নিয়মকানুনের মধ্যে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ধর্মঘট কোনো সমাধান নয়। আবার যারা এখন কাজ করছে তাদেরও অবমূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। আলোচনা হলে বরফ গলে যাবে।’

প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, ‘আমার পণ্য আমি কাকে দিয়ে কখন খালাস করব এটা আমার সহজাত অধিকার। কিন্তু এটা ঠিক করে দিচ্ছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা। বন্দরের পুরো ডিসচার্জিং (আনলোডিং) প্রক্রিয়াটিই মনোপলি পর্যায়ে চলে গেছে। ব্যবসার স্বার্থে এই মনোপলি ভাঙা দরকার। আবার যাদের নতুন করে লাইসেন্স দেওয়া হবে তাদেরও অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকা দরকার। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন লাইসেন্স দেওয়া হলে পুরো প্রক্রিয়াটি অস্বচ্ছ থেকে যাবে।’

বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ‘২৩টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে তারা এখনই পণ্য খালাস করতে পারবে না। পণ্য খালাসের জন্য তাদের আগে তালিকাভুক্ত হতে হবে। তালিকাভুক্ত হওয়ার পরই পণ্য খালাস কাজের সুযোগ পাবে তারা। বন্দরের বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে বছরে ৬ থেকে সাড়ে ৬ কোটি টন পণ্য খালাস করা হয়। বর্তমানে ৩২টি প্রতিষ্ঠান বহির্নোঙরে পণ্য খালাসে নিয়োজিত রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের আমদানি পণ্য খালাস করে। বাকি ২৭টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন আমদানিকারকের পণ্য খালাসে নিয়োজিত রয়েছে। এটি পর্যাপ্ত নয়। নতুন প্রতিষ্ঠান যোগ হলে কাজে আরও গতি আসবে। সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে।’ টেন্ডার ছাড়া অপারেটর নিয়োগের অভিযোগ সত্য নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তবে দ্বিমত পোষণ করে বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এ কে এম শামসুজ্জামান রাসেল বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কুতুবদিয়া বহির্নোঙর ও অন্যান্য বিশেষায়িত জেটিতে আসা দেশি-বিদেশি জাহাজের পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের জন্য রেগুলেশনস ফর ওয়ার্কিং অব চিটাগং পোর্ট (কার্গো অ্যান্ড কনটেইনার) ২০০১-এর প্রবিধানমালা অনুসরণ না করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ও দরপত্র ব্যতীত নতুন শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর তালিকাভুক্ত করতে চায়। যেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকাণ্ডে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ও দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও অনেক প্রতিষ্ঠান শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে ব্যর্থ হয়েছে; সেখানে কুতুবদিয়া, বহির্নোঙর ও অন্যান্য বিশেষায়িত জেটিতে কাজের জন্য দরপত্র ব্যতীত শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর তালিকাভুক্তি ও নিয়োগ করা অত্যন্ত অযৌক্তিক ও বেআইনি।’ এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশও রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে গেলেও তারা তা রিসিভ করা হয়িন বলে দাবি করেন রাসেল। প্রসঙ্গত বন্দরের বোর্ড সভায় গত বৃহস্পতিবারই নতুন ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

গোপনীয়তা রক্ষা করছে বন্দর

বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের কাজ করে থাকে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা। তবে যারা লাইসেন্স পেয়েছেন তাদের তালিকা প্রকাশ করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। কঠোর গোপনীয়তা বজায় রেখে এই কাজ সম্পন্ন করছে তারা। বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, গত ৪০ বছরে নতুন করে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরের লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে পণ্য আমদানি ছয় থেকে সাত গুণ বেড়েছে। প্রতিযোগিতা বাড়াতেই নতুন করে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে।

বর্তমান অপারেটরদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

চট্টগ্রাম বন্দর সীমায় জাহাজের আগমনী বার্তা ঘোষণার পর শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন তাদের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে পণ্য খালাসের জন্য কাজ বরাদ্দ দেয়। যারা কাজ পায় তারাই কেবল পণ্য খালাস করতে পারে। আগে পণ্য খালাসের দর নির্ধারিত হতো দু’পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে। অপারেটরগুলো নিয়ন্ত্রণ করত শিপিং এজেন্ট। ফলে অপারেটরদের মধ্যে কাজের প্রতিযোগিতা বাড়ত। পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে অপারেটরদের বিল থেকে কেটে নেওয়া হতো। কিন্তু এখন আর সেই প্রক্রিয়া নেই। দর নিয়ে এখন দ্বিমত করার সুযোগ নেই।

বড় শিল্প গ্রুপদের অভিযোগ, গত ১৬ বছরে বন্দরের বহির্নোঙরে কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিং তিনগুণের বেশি বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি নতুন অপারেটর। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে খোলা পণ্য নিয়ে জাহাজ এলে পণ্য খালাসের জন্য শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন এখন তাদের ইচ্ছেমতো পর্যায়ক্রম অনুসারে অপারেটর নিয়োগ করে। আমদানিকারক ও শিপিং এজেন্টরা চাইলেও পণ্য খালাসে তাদের পছন্দমতো দাম দিতে পারে না। প্রতিযোগিতামূলকভাবে দক্ষ অপারেটরও নিয়োগ করতে পারে না।

দেশের বৃহৎ ইস্পাত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, ‘আমরা চাইলেই আমদানি করা শিল্পের কাঁচামাল আমাদের পছন্দের অপারেটর দিয়ে খালাস করতে পারি না। অ্যাসোসিয়েশনের চাপিয়ে দেওয়া অপারেটর দিয়ে আমাদের পণ্য খালাস করতে হয়। এতে অর্থ ও সময় দুটোরই অপচয় হয়। প্রতিযোগিতা থাকলে এটা হতো না। তবে অদক্ষ প্রতিষ্ঠান যাতে এই খাতে আসতে না পারে সেদিকেও মনোযোগ দিতে হবে বন্দর কর্তৃপক্ষকে। ’

আইনি প্যাঁচে যেভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নতুন অপারেটর নিয়োগ

দরপত্রের মাধ্যমে ৫ বছরের জন্য শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর নিয়োগ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০১৫ সালের টেন্ডারের পর ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বরে পত্রিকায় টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বন্দর। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ২০২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবং ডিরেক্টরকে (ট্রাফিক) বিবাদী করে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট পিটিশন করে ৮টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর। এই রিট পিটিশনে বন্দরের টেন্ডার নোটিশে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর এবং বার্থ অপারেটরের সংজ্ঞাসহ বেশ কয়েকটি শর্ত নিয়ে আপত্তি তোলা হয়।

রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম এবং মুস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ চট্টগ্রাম বন্দরের টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি কেন অবৈধ হবে না এই মর্মে রুল জারি করেন। চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল আসে স্থগিতাদেশও। কিন্তু ৬ মাসের এই স্থগিতাদেশ রিসিভ করার আগেই ২৩ জনকে নতুন লাইসেন্স দিতে সুপারিশ করে বন্দরের বোর্ড অব ডিরেক্টরস।

যা বলছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন

বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং ও বার্থ অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান একেএম শামসুজ্জামান রাসেল বলেন, ‘অভিজ্ঞ অনেক স্টিভেডর্স লাইসেন্স চেয়েও পায়নি। রাজনৈতিভাবে যারা প্রভাবশালী তারা নামে-বেনামে এই লাইসেন্স নিয়েছে। নিয়ম মেনে স্বচ্ছতার সঙ্গে এই কাজটি করতে পারত বন্দর কর্তৃপক্ষ।’ তিনি আরও জানান, কোনো আমদানিকারক তাদের পণ্য খালাসের জন্য নিজস্ব সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট লাইসেন্স নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই খাতে শিল্প গ্রুপগুলো নিজেদের নামে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর লাইসেন্স না নিয়ে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে নিজেদের পণ্য খালাস করছে। শিল্প গ্রুপের মালিকানাধীন ৫টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর প্রায় ৬০ শতাংশ পণ্য হ্যান্ডলিং করছে। শামসুজ্জামান রাসেল আরও বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের নীতিমালা অনুসারে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এখানে সিন্ডিকেট কিংবা মনোপলি বিজনেসের সুযোগ নেই।

নিয়ম না মেনে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে নতুন অপারেটর নিয়োগের প্রতিবাদে আগামীকাল রোববার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল