• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

নিয়াজ মোর্শেদ: দাবার চালে অনন্য যিনি

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১৯ মে ২০২৩  

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ক্রিকেট নাকি ফুটবল কোনটা বেশি জনপ্রিয়, সেটি নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য, দুটি খেলাতেই বেশ আগ্রহ রয়েছে ক্রীড়াপ্রেমীদের। হাল আমলে এই দুই খেলার বাইরে অন্যকিছুর কথা যেন ভাবাই যায় না। তবে ক্রিকেট ও ফুটবলের বাইরে দেশে আরো একটি জনপ্রিয় খেলা রয়েছে। সেটি হলো দাবা।
দাবা দেশের সর্বমহলে জনপ্রিয় না হলেও যে ক’জন এই খেলাটির সঙ্গে নিজেদের জড়িয়েছেন, তাদের অধিকাংশই পৌঁছেছেন খ্যাতির চূড়ায়। যে তালিকায় নিঃসন্দেহে সবার উপরে থাকবেন নিয়াজ মোর্শেদ। 

ক্যারিয়ারের শুরু থেকে ৬৪ ঘরের রঙ্গমঞ্চে ক্ষণে ক্ষণে ঝড় তুলে ব্যক্তিগত অর্জনে অন্যসব ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের ছাপিয়ে উপমহাদেশের অন্যতম গ্র্যান্ড মাস্টারের খেতাব অর্জন করেছেন নিয়াজ মোর্শেদ। একই সঙ্গে দেশের ইতিহাসে ছয়বার জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়নের কৃতিত্বও তারই দখলে।

পাঠকদের জন্য আজকের এই পর্বে থাকছে নিয়াজ মোর্শেদের গ্র্যান্ড মাস্টার হয়ে ওঠার গল্প-

১৯৬৬ সালের ১৩ই মে রাজধানী ঢাকার সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নিয়াজ মোর্শেদ। এরপর সেখানেই বেড়ে ওঠা। পরিবারের সহযোগিতায় মাত্র ৯ বছর বয়স থেকে দাবা খেলা শুরু করেন তিনি। সে সময়ই জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নেন নিয়াজ। যদিও ওই প্রতিযোগিতায় গ্রুপ পর্ব অতিক্রম করতে পারেননি। কিন্তু টুর্নামেন্টে উপস্থিত সকলের নজর কাড়েন এ দাবাড়ু।

মাত্র ১২ বছর বয়সেই দেশের শীর্ষস্থানীয় দাবাড়ুদের একজনে পরিণত হন নিয়াজ। পরবর্তীতে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদশের জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে একাধারে ৪টি শিরোপা জেতেন। এর ৩০ বছর পর ২০১২ ও ২০১৯ সালে আবারো চ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় তোলেন। এতে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ছয়বারের মতো শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসেন তিনি।

১৯৭৯ সালে ভারতের কলকাতায় প্রথমবারের মতো যেকোনো পর্যায়ের আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নেন নিয়াজ। এরপর ১৯৮১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে যৌথভাবে প্রথম হলেও টাইব্রেকে দ্বিতীয় হন তিনি। পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজায় অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। একই বছর আন্তর্জাতিক মাস্টারে নর্ম অর্জন করেন দেশসেরা এ দাবা খেলোয়াড়।

নিয়াজ ১৯৮২ সালে বিশ্ব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন নিয়াজ। তবে ওই টুর্নামেন্টে অকৃতকার্য হলেও ডেনমার্কের লার্স স্কানডর্ফের বিরুদ্ধে তার দাবার লড়াইটি টুর্নামেন্টের সবচেয়ে সেরা খেলা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে যুগোস্লাভিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘বেলা ক্রোভা ওপেনে’ গ্র্যান্ড মাস্টারের প্রথম নর্ম অর্জন করেন। আর দ্বিতীয় নর্মটি অর্জন করেন ১৯৮৬ সালে। 

নিয়াজের প্রাপ্তির ঝুলিতে সবচেয়ে বড় সাফল্যে আসে ১৯৮৭ সালে। মাত্র ২১ বছর বয়সেই বিশ্ব দাবা সংস্থার (ফিদে) কাছ থেকে গ্র্যান্ড মাস্টারের মর্যাদায় ভূষিত হন নিয়াজ। যা তাকে বাংলাদেশ তো বটেই, একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এবং সমগ্র এশিয়ার মধ্যে ৫ম গ্র্যান্ড মাস্টারের খ্যাতি এনে দেয়। শুধু তাই নয়, বার্মা (বর্তমানে মিয়ানমার) থেকে তুরস্ক পর্যন্ত অঞ্চল নিয়ে ফিদের নবম আঞ্চলিক জোনের প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টারও তিনিই।

ফিদের গ্র্যান্ড মাস্টার মর্যাদা পেয়ে নিয়াজ বলেন, “এখন যেমন ফিদে মিটিং হয় দুই তিন মাস পরপর। আগে হতো এক বছর বা দশ-এগারো মাস পরে। আমার গ্র্যান্ড মাস্টার (জিএম) নর্ম ১৯৮৬ সালে হলেও ফিদের সভার কারণে সেটা ১৯৮৭ সালে আসে। দেরিতে এলেও যেদিন খবর পেলাম সেদিন অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করেছে। অনেক দারুণ অনুভূতি, ঠিক ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এটা আমাকে তখন ভালো খেলতে অনুপ্রাণিত করেছে।”

ফিদের সম্মানসূচক মর্যাদা পেয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন নিয়াজ। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে ভারতের গোডরিকে প্রথম, ফিলিপাইনের সেবু’তে গ্র্যান্ড মাস্টার টুর্নামেন্টে ২য়, কাতারের দোহা দাবা উৎসবে ৩য় এবং আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভ করেন তিনি।

গ্র্যান্ড মাস্টারের খেতাব অর্জনের পর সাময়িকভাবে দাবাকে বিদায় বলেন নিয়াজ। এরপর ক্যারিয়ার গড়তে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। সেখানে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যায়ন শুরু করেন। কিন্তু শেকড়ের ভালোবাসাকে ভুলতে পারেননি। এজন্য সুযোগ মিললেই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের দাবা টুর্নামেন্টে নিয়মিত অংশ নিতেন এ দাবাড়ু।

মেধাবী ক্রীড়াবিদের প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা আমার সৌভাগ্য মানুষ আমাকে এভাবে ভাবে। হয়তো ওই সময়টা কঠিন ছিল। এমনো দিন গেছে ঘুঁটি নেই, ঘড়ি নেই। ছোট ছিলাম, খেলতে গেছি, সিনিয়ররা চাল দিচ্ছে না, বসেই থাকতে হয়েছে। বই, ম্যাগাজিন ছিল না দাবার জন্য। শূন্য থেকে শুরু করে এই পর্যায়ে আসায় হয়তো মানুষ এটা বলে।

স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর ২০০৩ সালে দাবায় পুনরায় মনোযোগ দেন নিয়াজ মোর্শেদ। নতুন প্রজন্মের দাবাড়ুদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতার মুখোমুখি হয়ে ২০০৪ সালের কমনওয়েলথ দাবা প্রতিযোগিতায় টাইব্রেকারে দ্বিতীয় হয়েছিলেন তিনি।

বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে পাঁচবার প্রতিনিধিত্ব করেন নিয়াজ। এর মধ্যে ১৯৮৪, ১৯৯০, ১৯৯৪, ১৯৯৬, ২০০২ এবং ২০০৪ সালের দাবা অলিম্পিয়াডে অংশ নেন এ দাবাড়ু। ১৯৮৯ সালে ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে ভূষিত হন নিয়াজ।

দেশের ইতিহাসে নিয়াজের মতো দাবা খেলোয়াড়ের সংখ্যা সীমিত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি যেভাবে খ্যাতির ঝুলি ভরিয়েছেন, সেটি হয়তো অন্য কারো ক্ষেত্রে বেশ কঠিনই হবে। কেননা দেশের দাবায় উদীয়মান খেলুড়েদের প্রতি যত্ন ও সঠিক পদক্ষেপের অভাবে গ্র্যান্ড মাস্টার পাওয়া অনেকটাই দুস্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল