• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

লিওনেল স্কালোনি: আর্জেন্টিনার অধরা স্বপ্ন পূরণের মাস্টারমাইন্ড

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১৭ মে ২০২৩  

গঞ্জালো মন্টিয়েল ধীরস্থিরভাবে পেনাল্টি শট নিতে এগিয়ে এলেন। পুরো বিশ্বের আর্জেন্টাইন সমর্থকরা তখন প্রার্থনায় রত। গোল বলটি জালে জড়ানোর এক প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা, যা হলেই ঘুচবে দীর্ঘ ৩৬ বছরের অপেক্ষা। রূদ্ধশ্বাস কয়েক মুহূর্ত... সফল হলেন মন্টিয়েল, ফরাসি গোলরক্ষক হুগো লরিস পারলেন না তার শট আটকাতে।
আনন্দের আতিশয্যে সঙ্গে সঙ্গে জার্সি দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন মন্টিয়েল। ওদিকে ক্যামেরা চলে গেছে লিওনেল মেসির দিকে। পরম আরাধ্য বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের পর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিলেন তো তিনিই! কাতারের লুসাইল স্টেডিয়াম তখন মেসি মেসি ধ্বনিতে কাঁপছে।

ধারাভাষ্যকক্ষে পিটার ড্রুরি নামের একজন ‘কবি’ তখন বলে যাচ্ছেন, "Argentina, champions of the world. Again. At last. And the nation will tango all night long. 36 years ago since Maradona and Mexico, here finally is a nation's new throng of immortals. Scaloni will be fated, Messi will be sainted…"

বিশ্বজয়ের আনন্দে মধ্যমাঠে সতীর্থদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে দাঁড়ানো মেসি ততক্ষণে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছেন! সবাই তাকে জড়িয়ে ধরে উল্লাসে মত্ত। কেবল আর্জেন্টিনার ডাগআউটে দাঁড়ানো এক লম্বা, চিকন ব্যক্তির মুখে কোনো অনুভূতি খেলা করছে না। এমন মুহূর্তে যেন থমকে গেছেন তিনি! বুঝে উঠতে পারছেন না কীভাবে নিজের আবেগ প্রকাশ করবেন! 

কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন সেই ব্যক্তি। এরপর ভেতরে গিয়ে বসলেন, পানি পান করলেন। তারপর আবার মাঠের মাঝে এলেন। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আর পারলেন না আবেগকে আটকে রাখতে। মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে ফেললেন লিওনেল স্কালোনি নামের সেই ভদ্রলোক। যার নাম একটু আগেই নিয়েছেন ড্রুরি। আর্জেন্টিনার তিন যুগের অপেক্ষা, বারবার ফাইনালে গিয়েও শেষ মুহূর্তে হার নিয়ে ভাঙা হৃদয়ে ফিরে আসার পর এমন প্রাপ্তির পেছনের নায়ক তো ছিলেন স্কালোনিই!
আর্জেন্টিনার এই অর্জনে অমরত্ব পেয়েছেন লিওনেল মেসি। তার সঙ্গে অমরত্ব পেয়েছেন আরো একজন। তার নাম লিওনেল স্কালোনি। যিনি লা আলবিসেলেস্তেদের ৩৬ বছরের অপেক্ষা ঘুচানোর পেছনের সবচেয়ে বড় কারিগর। ঠান্ডা মাথায় প্রতিপক্ষ বুঝে আলাদা আলাদা পরিকল্পনায় যিনি একে একে অতিক্রম করেছেন কঠিন সব বাধা। তিনি না থাকলে আকাশী-নীলরা বিশ্বকাপ জিততো কি না, এমন প্রশ্ন করা হয়তো ভুল হবে না।

বছর চারেক আগেও স্কালোনির নাম বললে তাকে কেউ চিনতেন না সেভাবে। ফুটবলের পাঁড় ভক্তও হয়তো বলতে পারতেন না কে এই ভদ্রলোক! আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে চার বছরে খেলেছেন সর্বসাকুল্যে ৭ ম্যাচ। ২০০৬ ফুটবল বিশ্বকাপে একটি ম্যাচে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন। রাইটব্যাক হিসেবেই জাতীয় দল ও ক্লাব ফুটবলে খেলেছেন। মাঝে মাঝে দেখা গেছে রাইট মিডফিল্ডার হিসেবেও। তবে বলার মতো পারফরম্যান্স করতে পারেননি, তারকাখ্যাতিও ছিল না খুব একটা।

২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ভরাডুবির পর একই বছরের ৩ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসেবে জাতীয় দলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় স্কালোনির হাতে। ১৯৭৮ সালের ১৬ মে আর্জেন্টিনার সান্তা ফে-র ছোট শহর পুজাতোতে জন্ম নেয়া সাবেক এই ফুটবলারের বয়স তখন মাত্র ৪০, অভিজ্ঞতা বলতে ছিল শুধু আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব-২০ দলকে অর্ধমাস কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা। আর জাতীয় দলের সহকারী কোচ হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতাও মাত্র ১ বছর। স্বাভাবিকভাবেই তাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখাননি কেউ। 

আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনা তো স্কালোনিকে নিয়োগের পর বলেই ফেলেন, "Scaloni is a good guy, but he can't even direct traffic. The problem is tomorrow he becomes a coach and says 'I want to go to the World Cup'. You can go to the World Cup of motorcycling, not football."

এছাড়া আরো অনেক ফুটবলবোদ্ধাই স্কালোনিকে তির্যক কথার বাণে বিদ্ধ করেন। তবে কাউকে উত্তর দেননি এই ভদ্রলোক। চুপচাপ জাতীয় দলকে সামলানোর দিকে মনোযোগ দেন তিনি।

এরপরই যেন জন্ম হলো নতুন এক আর্জেন্টিনার। মেসি, অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া, নিকোলাস ওটামেন্ডিদের মতো অভিজ্ঞদের নিয়ে ধীরে ধীরে দাঁড় করান একটি শক্ত লাইন আপ। তাদের সঙ্গে দলে খেলাতে থাকেন কিছু তরুণ তুর্কিকে। যাদের মাধ্যমে দলের রসায়ন জমাটবদ্ধ হয় আরো বেশি। দল অন্তঃপ্রাণ এসব খেলোয়াড়দের সুনিপুণভাবে পরিকল্পনামাফিক খেলাতে থাকেন স্কালোনি। যার ফলে আলবিসেলেস্তেরা একসময় হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য।

কাতার বিশ্বকাপের আগে টানা ৩৬টি ম্যাচ অপরাজিত ছিল আর্জেন্টিনা। যা স্কালোনির দারুণ ম্যানেজিং সক্ষমতার প্রমাণ। ততদিনে তার অধীনে আকাশী-নীল শিবির জিতেছে কোপা আমেরিকা ও ফাইনালিসিমার মতো দুটি ট্রফি। তবে সবারই লক্ষ্য ছিল বিশ্বকাপ শিরোপা। যেখানে প্রথম ম্যাচেই অপ্রত্যাশিতভাবে বড় ধাক্কা খায় আলবিসেলেস্তেরা, সৌদি আরবের মতো দুর্বল প্রতিপক্ষের কাছে লিওনেল মেসিরা হেরে যান ২-১ ব্যবধানে।

তখন থেকে প্রতিটি ম্যাচই আর্জেন্টিনার জন্য পরিণত হয় অলিখিত ফাইনালে। এমন চাপের মুখে ভেঙে না পড়ে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্কালোনি, দেখান নিজের মাথার খেল। ম্যাচ বাই ম্যাচ প্রতিপক্ষকে বুঝে সেভাবে সাজাতে থাকেন একাদশ, বদল আনেন পরিকল্পনায়। মূলত ৪-৪-২ ফরমেশনে দলকে খেলালেও প্রয়োজনের সময় ৪-৪-১-১, ৪-৩-৩ এমনকি ৩-৫-২–এর মতো ফরমেশনও ব্যবহার করেছেন এই কোচ। খেলার মাঝেই ফরমেশন ভেঙেছেন, গড়েছেন তিনি। যার ফলে দিশেহারা হয়ে চাপে পড়েছে প্রতিপক্ষরা, আর শেষ হাসি হেসেছে আর্জেন্টিনা।

স্কালোনি তার শিষ্যদের কাছে কতটা প্রিয়, তা বোঝা যায় আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার রদ্রিগো ডি পলের একটি কথায়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘যদি এখন সকাল ১০টা বাজে এবং স্কালোনি আমাদের বলেন শুভ রাত্রি, তাহলে আমাদের কাছে এটাই রাত।’

স্কালোনির বুদ্ধিমত্তার অনন্য এক উদাহরণ হয়ে থাকবে কাতার বিশ্বকাপ ফাইনাল। যেখানে ফ্রান্সকে মোকাবেলা করতে অনুশীলনের সময় দলকে ৩-৫-২ ফরমেশনে খেলাতে থাকেন তিনি। এটা দেখে অধিকাংশ গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করে, ফাইনালে ৩-৫-২ ফরমেশনে খেলবে আর্জেন্টিনা। কিন্তু ফাইনাল শুরু হওয়ার পর দেখা যায়, মেসিরা খেলছেন ৪-৩-৩ ছকে। 

এদিন প্রায় পুরো টুর্নামেন্টে ডান দিকে উইঙ্গার হিসেবে খেলা দি মারিয়াকে বাঁ দিকে নামান স্কালোনি। বাঁ পায়ের এই ফুটবলার ম্যাচের শুরু থেকেই বারবার ফ্রান্সের বাম পাশের ডিফেন্সকে নাচাতে থাকেন। ড্রিবল করে ডি বক্সে ঢোকা থেকে শুরু করে বাঁকানো ক্রসে আলভারেজ-মেসিকে খুঁজে নেয়ার চেষ্টায় ফরাসিদের রীতিমতো নাকানিচুবানি খাওয়াতে থাকেন তিনি। তারই কল্যাণে প্রথম পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। কিছুক্ষণ পর দলের হয়ে দ্বিতীয় গোল করে ফরাসিদের কোণঠাসা করে দেন মিস্টার অ্যাঞ্জেল।

এছাড়া ফ্রান্সের মূল শক্তি ছিল তাদের আক্রমণভাগ, দুর্বলতা ছিল মাঝমাঠে। স্কালোনি এটা বুঝতে পেরে খেলান তিন মিডফিল্ডার- রদ্রিগো ডি পল, এনজো ফার্নান্দেজ ও অ্যালেক্সিস ম্যাক আলিস্টারকে। তাদের দিয়েই দখল করে রাখেন মাঝমাঠ। জমাট রক্ষণের সঙ্গে এই ত্রয়ীর বুদ্ধিদীপ্ত ওঠানামা করার উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না ফ্রান্স। কিলিয়ান এমবাপ্পের নৈপুণ্যে খেলা টাইব্রেকার পর্যন্ত গড়ালেও পুরো ম্যাচে আধিপত্য দেখিয়েছে আর্জেন্টিনাই। আর পেনাল্টি শ্যুট আউটের মহানায়ক এমি মার্টিনেজের উঠে আসাও কিন্তু স্কালোনির হাত ধরেই।

২০০৬ সালের বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেয়েছিলেন হাভিয়ের জানেত্তির জায়গায়। যা সে সময় তুমুল সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। সেবার নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি তিনি। আবার জাতীয় দলের দায়িত্ব নেয়ার সময়েও শিকার হন সমালোচনার ঝড়ের। তবে এবার আর পেছনে ফিরে তাকাননি। সাফল্যের শিখরে ঠিকই উঠেছেন কোচ হিসেবে। যেন দেখিয়ে দিয়েছেন, শূন্য থেকেও সর্বোচ্চ সাফল্য পাওয়া যায়, প্রয়োজন শুধু একনিষ্ঠতার।

আর্জেন্টাইন মহাতারকা মেসির সঙ্গে স্কালোনির মিল আছে বেশ কিছু জায়গায়। দুজনের নামে লিওনেল তো আছেই, তাদের জীবনের প্রথম দল নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাব। স্কালোনি আর মেসি একসময় খেলেছেন সতীর্থ হিসেবে। দুজনেরই পেশাদার ক্যারিয়ারের বড় অংশ কেটেছে লা লিগায়। আকাশী-নীলদের বহু আরাধ্য বিশ্বকাপ শিরোপা অর্জনে দুজনের ভূমিকা দুরকম হলেও ফুটবল ইতিহাসে নিজেদের কাজ দিয়ে ঠিকই অমরত্ব পেয়েছেন তারা। 

বিশ্ব ফুটবলে আর্জেন্টিনা যতদিন থাকবে, ততদিন ভক্ত ও সমর্থকদের কাছে একজন কিংবদন্তি হিসেবেই থাকবেন স্কালোনি। তিনি হয়ে থাকবেন স্বপ্ন পূরণের একজন মাস্টারমাইন্ড হয়ে, যার অনবদ্য বুদ্ধিমত্তায় একে একে বিধ্বস্ত হয়েছিল প্রতিপক্ষরা। আর স্বর্গের সুখ লাভ করেছিলেন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আকাশী-নীলের স্বপ্নবাজরা।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল