• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

কালিহাতীতে ইটভাটায় বাড়ছে শিশুশ্রম, পুড়ছে বনের কাঠ

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১ ডিসেম্বর ২০২২  

টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে অবাধে বনের কাঠ পুড়িয়ে চলছে ইট তৈরির কাজ। ভাটার চারপাশে রয়েছে জ¦ালানি কাঠের বিশাল স্তুপ। সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে উপজেলার কোকডহড়া ইউনিয়নের বানিয়ারা এলাকায় চলছে মেসার্স এফ বি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ইটভাটা। মেয়াদ উত্তীর্ণ লাইসেন্স ব্যবহার করে ঘনবসতিপূর্ণ ও ফসলি জমির পাশেই অবাধে চলছে ইটভাটাটি। নিয়মানুযায়ী এসব ভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করার কথা। কিন্তু ভাটায় কয়লা ব্যবহার না করেই প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এসব কাঠ সংগ্রহ করা হচ্ছে পাশের বনাঞ্চল থেকে। আবার সৃষ্ট ধোঁয়ায় বৃদ্ধ ও শিশুদের দেখা দিচ্ছে শ্বাসকষ্ট। শুধু তাই নয়, শিশুশ্রম আইনকে তোয়াক্কা না করেই শিশুদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন ভাটার মালিক।

সরজমিনে ইটভাটা ঘুরে দেখা গেছে, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এ ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষি জমির মাটি। ভাটার দুই পাশে স্তপ করে রাখা হয়েছে কৃষি জমির মাটি। ফলে একদিকে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে বন, অন্যদিকে উর্বরতা হারিয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে জমি।


এদিকে ইটভাটায় থরে থরে সাজানো কাঁচা ইট। রোদে শুকানোর পর এগুলো উঠছে চুল্লিতে। আগুনের তাপে পুড়ছে ইট। সেই সঙ্গে পুড়ছে যেন শিশুর স্বপ্নও। কারণ, এসব ইটভাটায় অনেক শিশু লেখাপড়া বাদ দিয়ে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। ওদের বয়স ৭ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। কাঁচা ইট রোদে শুকানো, ইট তৈরি, ট্রলিতে করে ইট টেনে ভাটাস্থলে পৌঁছানো, মাটি বহন করাসহ সব কাজেই নিয়োজিত এসব শিশু। তাদের আর্থিক লোভ দেখিয়ে কঠিন ও ভারি কাজে যুক্ত করছে ভাটা মালিকরা। এতে মানা হচ্ছে না শিশু শ্রম আইন। ফলে একদিকে ব্যাহত হচ্ছে তাদের মেধা বিকাশ ও শিক্ষা কার্যক্রম, অপরদিকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন ইটভাটার মালিকরা।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, আকারভেদে একটি ইট ভাটা গড়তে কমপক্ষে পাঁচ একর (৫০০ শতাংশ) জমি প্রয়োজন। আর এসব ইট ভাটা গড়ে ওঠার কারণে চার শতাধিক একর ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইটভাটার ম্যানেজার জানান, সাধারণত মধ্যম সারির একটি ভাটায় বছরে ৪০ থেকে ৫০ লাখ ইট পোড়ানো হয়। আর প্রতি আট হাজার ইটের জন্য কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার হয় এক হাজার ঘনফুট মাটি। সেই মাটির জোগান আসে কৃষি জমি থেকে। এজন্য প্রতিটি ভাটায় বছরে পাঁচ থেকে ছয় একর জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহার করা হয়। সে হিসাবে একটি ভাটায় প্রতি মৌসুমে অন্তত চার থেকে পাঁচ একর জমির মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, ইট পোড়ানোর জন্য প্রতিটি ভাটায় দৈনিক গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ মণ কাঠ পোড়াতে হয়। কাঠ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, বিভিন্ন এলাকা ও বনাঞ্চল থেকে সংগৃহীত কাঠ এসব ভাটায় জোগান দেওয়া হয়।


ইট ভাটার ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণ ছাড়াও স্থানীয়রা নানা ধরনের সমস্যার কথা জানিয়েছেন। ওই এলাকার কয়েকজন কৃষক বলেন, ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষেতের পাশে ইট ভাটা গড়ে ওঠায় আগের তুলনায় উৎপাদন কমে গেছে। সরকার ফসলি জমির ওপর ইট ভাটা স্থাপন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পাঁচ বছরের মধ্যে এসব জমির উৎপাদন শূন্যে নেমে আসবে। স্থানীয়রা আরও বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের রোগব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে অসুস্থতা বেড়েছে।

ওই ব্রিকস ফিল্ডে কর্মরত সাতক্ষীরা এলাকার লিটনের ছেলে ইমন (৮), জালাল সিকদারের ছেলে নুরুল হোসেন (১২) ও রুহুলের ছেলে মহসিন (১৪) এ প্রতিবেদককে জানায়, দীর্ঘ দিন ধরে তারা এ ইটভাটায় কাজ করছে। বছরের ৬ মাস তারা কাঁচা ইট রোদে শুকানো, ইট তৈরি, ট্রলিতে করে ইট টেনে ভাটাস্থলে পৌঁছানোসহ বিভিন্ন কাজ করে থাকে। এরজন্য বয়সের অনুপাতে এবং কাজের পরিমান বুঝে তাদের ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়। এতে করে পরিবারের বাড়তি আয় আসে। তাই তারা পরিবারের অনান্য সদস্যদের সাথে ভাটায় কাজ করে থাকে।
ডা. আবিবুর রহমান বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যদি কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়, তাহলে এর বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টসহ শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের প্রকোপ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। ফলে এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।


মেসার্স এফ বি এন্টারপ্রাইজ ইটভাটার মালিক মো: ফজলু মিয়া এ প্রতিবেদককে জানায়, ভাটায় কাঠ পুড়িয়ে আগুন জ¦ালাতে হয়। পরে আর কাঠের ব্যবহার করি না। ইট পুড়ানোর লাইসেন্স বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ভাটার সব কাগজপত্র ঠিক আছে। কিন্তু পরে আর তিনি লাইসেন্সের সঠিক কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। শিশুশ্রম বিষয়ে তিনি বলেন, ভাটায় ওদের বাবা-মা কাজ করে তাই শিশুরাও কাজ করে। আমরা তাদের জোর করে কাজ করতে বলিনি।

টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি কাটা হলে এর উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে জমিতে ফসল উৎপাদন ব্যাপক হারে কমে যায়। এছাড়া ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে যদি কোন ভাটা মালিক কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করে তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইট ভাটায় কাঠ পুড়ানোর ধোঁয়ায় পরিবেশ ও সাধারণ মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আমরা বিগত দিনে জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা ও ভাটা বন্ধ করেছি। এবছরও আমরা অবৈধ ইটভাটা এবং যারা নিয়মনীতি না মেনে কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবো।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল