• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

বাসাইলে জীবনযুদ্ধে হার না মানা রোজিনার গল্প

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১০ মার্চ ২০২২  

শারীরিক অসুস্থতার জন্য রোজগার করতে না পারায় এক স্বামী তার স্ত্রী-কন্যাদের খাবার যোগাতে পারছিলেন না। অভাবের সংসারের হাল ধরতে তাই পথে নেমেছেন স্ত্রী রোজিনা আক্তার। টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার আইসড়া গ্রামের এই নারী জেলা শহর ও আশেপাশের এলাকায় চলাচলকারী প্রায় ১০ হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালকদের মধ্যে একমাত্র নারী চালক।

টাঙ্গাইল শহরের একপ্রান্ত নতুন বাসস্ট্যান্ড থেকে আরেক প্রান্ত বেবিস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তায় প্রতিদিন ভাড়া করা অটোরিকশায় যাত্রী পরিবহন করতে দেখা যায় এই ত্রিশোর্ধ নারীকে। শহরে যানজটের পাশাপাশি নানা ঝামেলা সামলাতে পুরুষ চালকরা যখন অটোরিকশা চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন, তখন গত সাড়ে ৩ বছর ধরে চলছে রোজিনার এই কাজ।

রোজিনা বলেন, 'আমি খুব হিসাব করে অটো চালাই। খুব দ্রুত গতিতেও না, আবার একেবারে আস্তেও না। এখনও অ্যাকসিডেন্ট করি নাই।'

'শহরের পুরুষ অটোরিকশা চালকরা আমাকে সম্মান করে। আমি যখন রাস্তার ওপর অটো ঘুরাই তারা নিজেদের অটো দাঁড় করে রেখে আমাকে সুযোগ দেন। বড় গাড়ির চালকরাও যখন দেখেন আমি নারী তখন তারাও আমার প্রতি সম্মান দেখান।'

অটোরিকশার যাত্রী নিজাম উদ্দিন বলেন, 'অটোর চালক একজন নারী দেখেও আমি তার অটোতে চড়েছি। তিনি খুব ভালো চালিয়েছেন।'

যাত্রী সাইফুল ইসলাম বলেন, 'নারী অটোচালকের পাশের সিটে বসতে কিছুটা সংকোচ বোধ হলেও চালক ছিলেন নির্বিকার।'

রোজিনার সাহসিকতাকে বাহবা জানিয়ে স্থানীয় নারী সংগঠক কামরুন্নাহার মুন্নী বলেন, 'আমি রোজিনাকে স্যালুট জানাই। একজন পুরুষের চেয়ে একজন নারী কোনো দিক থেকেই কম নন, রোজিনা তা প্রমাণ করেছেন।'

জানা যায় ৩ মেয়ে ২ ছেলের মধ্যে বড় মেয়ে রোজিনাকে বাবা-মাহীন এক অনাথ যুবকের কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন তার গরিব তাঁত শ্রমিক বাবা। বিয়ের পর জন্ম হয় ২ কন্যা সন্তানের। অটোরিকশা চালিয়ে কোনক্রমে সংসার চালাচ্ছিলেন স্বামী রফিকুল। কিন্তু, ছেলেবেলায় দুর্ঘটনায় রফিকুলের এক চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট অপরটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত চোখের দৃষ্টি শক্তি আরও ক্ষীণ হয়ে গেলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছিল অটোরিকশা চালানো।

সংসারের উপার্জনক্ষম মানুষটি অচল হয়ে পড়ায় স্বামীর চিকিৎসার খরচ, ঘরভাড়া, খাওয়ার পাশাপাশি মেয়েদের পড়ালেখার খরচ বন্ধ হয়ে যায়। দিশেহারা রোজিনা মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে এবং এনজিও থেকে ধার করে কোনক্রমে সংসার চালাতে পারলেও মেয়েদের লেখাপড়া ও অন্যান্য খরচ জোগাড় করতে পারছিলেন না।

এমন পরিস্থিতিতে রোজিনা নিজে অটোরিকশা চালাতে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং স্বামী রফিকুলের কাছে তা শিখতে চান। গ্রামের স্কুলের মাঠে স্বামীর কাছে অটোরিকশা চালানো শেখেন রোজিনা। পরে গ্রামের পথে ৩-৪ দিন অনুশীলন করে অটোরিকশা নিয়ে একদিন সরাসরি টাঙ্গাইল শহরে চলে আসে রোজিনা। এভাবে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যান তিনি।

রোজিনা আরও বলেন, 'সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমার জন্য খুব সহজ ছিল না। ৭ আর ২ বছর বয়সী মেয়েকে ভাড়া বাসায় রেখে অটোরিকশা নিয়ে সারাদিন রাস্তায় থাকতে হয়।'

ভাড়া বাড়িতে থাকার খরচ কমাতে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এক টুকরো জমি কিনেন রোজিনা। পরে সেখানে সরকার তাকে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর করে দেয়।

আইসড়া গ্রামের ইদ্রিস আলী বলেন, 'রোজিনাকে অটোরিকশা চালাতে দেখে আগে গ্রামের কিছু মানুষ বিদ্রূপ করতো। পরে রোজিনার সংকল্প আর দৃঢ়তা দেখে তারা থেমে যায়। এখন আমরা তাকে নিয়ে গর্ব করি।'

রোজিনা বলেন, 'যখন খুব অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছিলাম তখন মানুষ আমাদের অবজ্ঞা করেছে। যখন জীবনের তাগিদে অটোরিকশা চালাতে শুরু করি তখনও নানা কথা বলেছে। তবে এখন তারাই আমাকে সম্মান করেন।'

রোজিনার ২ মেয়ে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে।

রোজিনা বলেন, 'আমার তো থেমে যাওয়া চলবে না। মেয়েদের শিক্ষিত করতে হবে। ধারদেনা শোধ করতে হবে। কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলের ডিসি সাহেব আমাকে গাভি উপহার দিয়েছেন। ভাড়ার অটোরিকশা চালিয়ে আয় কম হয়। তাই আমার আশা যতদিনই লাগুক নিজে অটোরিকশা কিনবো।'

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল