• শনিবার ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ২০ ১৪৩১

  • || ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

তদন্তে সম্পৃক্ততা না পেলে মামলা থেকে নাম বাদ

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪  

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডসহ যেসব অভিযোগে মামলা হচ্ছে, সেগুলোর প্রাথমিক তদন্তে কোনো আসামির সম্পৃক্ততা না পাওয়া গেলে মামলা থেকে তার নাম প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে বলেছে পুলিশ সদর দপ্তর। একই সঙ্গে সঠিক তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এসব মামলায় কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বলেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (কনফিডেনশিয়াল) কামরুল আহসান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এসব নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে ডিআইজি বলেন, গত ১০ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এই চিঠি জারি করা হয়।

এর মধ্যে চিঠিটি পুলিশের সব ইউনিটে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ওই চিঠিতে আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির প্রথম সভার কার্যবিবরণীর উদ্ধৃতি দিয়ে আরো বলা হয়, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান ঘিরে হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য মামলায় তদন্ত ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া না গেলে তাঁদের নামও প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নিতে হবে।

ওই চিঠি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিভিন্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। চিঠি পাওয়ার বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চিঠির বিষয়টি শুনেছি, তবে হাতে পাইনি।

র‌্যাব সব সময় আইনের মধ্য থেকেই তাদের দায়িত্ব পালন করে থাকে। কাউকে গ্রেপ্তারের আগে সব তথ্য যাচাই-বাছাই করি আমরা। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ র‌্যাবের হাতে থাকে।’
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় ঢালাওভাবে করা মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের আসামি করা হচ্ছে।

তথ্য যাচাই-বাছাই না করেই স্বনামধন্য ব্যবসায়ী, অরাজনৈতিক ব্যক্তি, ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না এমন নিরপরাধ ব্যক্তিদের আসামি করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, চাঁদা না পেয়ে কিংবা ব্যাবসায়িক প্রতিহিংসা অথবা রাজনৈতিকভাবে হেনস্তা করতে এসব মামলা করা হচ্ছে।
এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামেই ১৬৫টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ১৪৭টিতে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। বাকি ১৮টি মামলা হয়েছে হত্যাচেষ্টা ও অপহরণের অভিযোগে।

গণ-আসামি হিসেবে করা এসব মামলার বিচারের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

তাঁরা বলছেন, জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে হতাহতের বিচার চেয়ে দেশজুড়ে যেসব মামলা হচ্ছে, এতে ভুক্তভোগীর পরিবার সঠিক বিচার পাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে দেশে যেভাবে ঢালাওভাবে মামলা করা হচ্ছে, এসব মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করলে যে কেউ বুঝতে পারবে, এগুলো মিথ্যা মামলা। একটি খুনের ঘটনায় করা মামলায় ১৫ থেকে ২০ জন আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী, আরো ডজন ডজন আসামি। এগুলো দেখলেই বোঝা যায়, আসল ঘটনার সঙ্গে এসব মামলার সংশ্লিষ্টতা নেই।

 

মনগড়া এজাহার

গত ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আন্দোলনে যে প্রাণহানি হয়েছে, সে বিষয়ে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় করা হচ্ছে বহু মামলা। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণহানি ও হতাহতের ঘটনায় ঢালাওভাবে মামলা ও আসামি করে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলাগুলোতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে এবং মনগড়া এজাহার দেওয়া হয়েছে বলেও জানা যায়। নানা অসংগতিতে মামলাগুলো গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে মানবাধিকার কমিশন বলেছে, যাত্রাবাড়ীতে ইমরান হোসেন নামের এক তরুণকে হত্যার মামলায় প্রথিতযশা আইনজীবী, স্বনামধন্য সাংবাদিকসহ ২৯৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশের নন-অপারেশনাল ইউনিটে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে।

শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীকে আসামি করে জুনের মৃত্যুকে আগস্টের আন্দোলনে নিহত দেখিয়ে মামলা করা হয়েছে। দেশের বাইরে থেকেও কেউ কেউ ‘ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে গুলি ছুড়ে’ হয়েছেন অভিযুক্ত।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একই ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন এজাহার ও ভিন্ন ভিন্ন আসামির নাম দিয়ে মামলা করা হয়েছে। এ ধরনের নির্বিচারে আসামি করা মামলাকে ‘দুর্বল করে’ এবং তা প্রকৃত অপরাধী শনাক্তকরণে বাধা দেয়।

এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, নির্বিচারে ও ঢালাওভাবে আসামি করে মামলা করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটি অনৈতিক এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। মামলাগুলো বস্তুনিষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন।

 

গ্রেপ্তারকৃতরা দফায় দফায় রিমান্ডে

বিভিন্ন মামলায় এখন পর্যন্ত সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আইজিপি, সরকারি কর্মকর্তাসহ আরো অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারো কারো জায়গা হয়েছে কারাগারে।

 

নিরপরাধকে হয়রানি না করার অনুরোধ

যাচাই-বাছাই না করে মিথ্যা বা ভুয়া মামলা দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি না করার অনুরোধ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গত বুধবার আন্দোলনের মিডিয়া উইংয়ের সমন্বয়ক তাহমীদ আল মুদ্দাসসীর চৌধুরীর পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই অনুরোধ জানানো হয়।

 

নিরপরাধ ব্যক্তিরাও মামলার জালে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই ময়মনসিংহের ফুলপুরে ধান বিক্রি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন কৃষক সাইফুল ইসলাম (৩৭)। এ নিয়ে ঘটনার এক মাস পর গত ২০ আগস্ট আদালতে মামলা করেন জেলা উত্তর কৃষক দলের সদস্যসচিব শাহ মোহাম্মদ আলী। মামলায় আসামি হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ ৬৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। একই মামলায় আসামি করা হয় বিএনপি নেতা আব্দুল খালেক, আলাল উদ্দিন, আব্দুল মালেক ও ব্যবসায়ী হাজি সেকান্দর আলীকে। স্বার্থ হাসিল করতে ওই মামলায় বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ীদের নাম যুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠার পর গত ২৫ আগস্ট মামলা প্রত্যাহার করেন তিনি। গত ২৭ আগস্ট দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। অবশ্য মোহাম্মদ আলীর অভিযোগ, উত্তর জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক আবুল বাশার আকন্দের নির্দেশে তিনি মামলাটি করেন।

সূত্র মতে, গত ৩০ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের ৪২ জেলায় হত্যা ও সহিংসতার ২৫১টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনাকে গণহত্যা, হত্যা ও গুমের ১০৩টি মামলায় আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া গত ১৪ থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আটটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হয়েছে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও নির্দেশ দিয়েছেন, মামলায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে প্রতিহিংসার শিকার না হন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় মামলা করতে হবে, যাতে কারো প্রতি অবিচার করা না হয়। এখন যেসব মামলা হচ্ছে, তা কতটুকু ফলপ্রসূ, তার যৌক্তিকতা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এটি যেন ‘মব জাস্টিস’ না হয়ে যায়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির সদস্য নূর খান বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাঁদের হত্যার বিচারের দাবিতে যে মামলাগুলো হচ্ছে, সেখানে একটি স্বার্থান্বেষী মহল ফায়দা লোটার সুযোগ খুঁজছে। দুই কোটি টাকা চাঁদা না দেওয়ায় এক ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি, সাংবাদিক, শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ অনেকের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা হচ্ছে, যেগুলোর সত্যতা নিয়ে এরই মধ্যে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।