• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

ভবিষ্যতে সুলভে মিলবে শুধু চাষের মাছ

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১২ মে ২০২৩  

মৎস্য চাষে দেড় দশকে উৎপাদন বেড়েছে ১৫০ শতাংশেরও বেশি। চাষের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদনে (অ্যাকুয়াকালচার) বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে এখন পঞ্চম। সামনের দিনগুলোয়ও এ ধারা বজায় থাকবে বলে মনে করছে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষক সংস্থা। এসব সংস্থার ভাষ্যমতে, কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে আমিষের সবচেয়ে সুলভ উৎস হয়ে উঠতে যাচ্ছে মাছ। বিশেষ করে অ্যাকুয়াকালচারে ব্যাপক অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় মাছের উৎপাদন ও জোগান চাহিদাকে ছাড়িয়ে যাবে। মূল্যস্ফীতির কারণে বাজারে অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়লেও মাছের ওপর এর প্রভাব থাকবে সামান্য। বরং চাষের মাছ পাওয়া যাবে এখনকার চেয়েও সুলভে।


আন্তর্জাতিক খাদ্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) এক প্রক্ষেপণের হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০৩০ সালের মধ্যেই দেশে অ্যাকুয়াকালচারে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির গতি চাহিদার প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যাবে। একই সঙ্গে বর্তমানের তুলনায় মাছের দামও কমে যাবে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মাছের উৎপাদন বাড়তে পারে এখনকার তুলনায় ৭০ শতাংশের বেশি। সে ক্ষেত্রে বার্ষিক উৎপাদন ৪৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদনে গতিশীল প্রবৃদ্ধির কারণে ওই সময়ে বাজারে চাষের মাছের প্রকৃত মূল্য থাকবে এখনকার তুলনায় আরো কমতির দিকে।

এখন পর্যন্ত মৎস্য চাষে বাংলাদেশের সম্ভাবনার পুরোটাকে কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি বলে মনে করছে আইএফপিআরআই। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, নিবিড় ও বিজ্ঞানসম্মত মৎস্য চাষের মাধ্যমে দেশের অর্ধেক পুকুর- জলাশয় ব্যবহার করেও মাছের উৎপাদন এখনকার তুলনায় কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব।

দেশে মাছের বাজারে অন্যান্য পণ্যের তুলনায় প্রতিযোগিতা বেশি। মৎস্য উৎপাদনে অগ্রগতিতে সফলতার জন্য মূলত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামারি ও মৎস্য চাষীদেরই কৃতিত্ব দেয়া হয় সবচেয়ে বেশি। কোনো একক প্রতিষ্ঠান বা সত্তার পক্ষে চাষকৃত মাছের বাজারের দখল নেয়া সম্ভব না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্যমতে, সে ক্ষেত্রে কোনো গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চাল-চিনি বা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মতো মাছের দাম অস্থিতিশীল করে তোলার সুযোগ কম। খামারিদের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে উৎপাদন ও বাজারজাতে প্রশিক্ষণ দেয়া গেলে রফতানি বাণিজ্যেও বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে অ্যাকুয়াকালচার।

গত কয়েক বছরে দেশে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে অনেক। যদিও বাজারে চাষ করা মাছের দাম আগের পর্যায়েই রয়েছে। মূল্যস্ফীতির বাজারেও নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে পাঙাশ, তেলাপিয়া, রুইসহ চাষ করা মাছগুলো। বিশেষ করে পাঙাশের জনপ্রিয়তা নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এ শ্রেণীর মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তায় চাষকৃত মাছের এখন পাঙাশই রাখছে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা।

চাষ পদ্ধতিতে আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো গেলে খাতটিতে আরো অনেক সফলতা আসবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. আবুল মনসুর। তিনি বলেন, ‘উদ্যোক্তারা যদি সঠিক দাম পায় তাহলে উৎপাদন আরো বাড়বে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া মৎস্য বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরাও মৎস্য চাষে ভূমিকা রাখছেন। মৎস্যচাষীদের সঙ্গে যদি আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটে, তাহলে আরো অনেক সফলতা আসবে এ খাতে। ক্ষেত্রবিশেষে যদি ঋণ দেয়া যায়, তাহলে চাষীরা নতুন উদ্যমে কাজ করতে পারবেন।’

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরেও দেশে চাষের মাছ উৎপাদন হয়েছিল মাত্র ১ লাখ ৮ হাজার টন। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ১০ লাখ ৬ হাজার টনে। সেখান থেকে ১৫০ শতাংশেরও বেশি বেড়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৩৯ হাজার টন। দেশে চাষের মাছের মধ্যে পাঙাশ, রুই, তেলাপিয়া, সরপুঁটি ইত্যাদির উৎপাদন হয় সবচেয়ে বেশি। বাজারে চাহিদাও অনেক। আবার এসব মাছের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি নিয়েও গবেষণা চলছে নিয়মিত।

দেশে চাষকৃত মাছের মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে পাঙাশ—৩ লাখ ৯১ হাজার টন। এর পরের অবস্থানে রয়েছে তেলাপিয়া। ওই অর্থবছরে দেশে তেলাপিয়া উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ১৬ হাজার টন। রুই মাছ উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৯৫ হাজার টন।


শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব বলেন, ‘দেশে উৎপাদিত মাছের ৬০ শতাংশ আসে চাষের মাছ থেকে। উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছের উৎপাদন বাড়ছে না। কমে আসছে। মানুষ বাড়ছে, জায়গা কমছে। মাছ চাষের বিকল্প নেই। উন্মুক্ত সমুদ্রেও মাছ আহরণ কমে আসছে। দেশে মাংসের দাম যে হারে বেড়েছে সেই তুলনায় মাছের দাম কিন্তু বাড়েনি। এক্ষেত্রে অ্যাকুয়াকালচারই বড় ভূমিকা রাখছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘অ্যাকুয়াকালচারের মাছ চাষ বাড়লেও দাম বাড়ছে না, কারণ মাছের সহজলভ্যতা। অ্যাকুয়াকালচার থেকে যে মাছ উৎপাদন হয় তা আমাদের দেশের বাইরে রফতানির সুযোগ বাড়াতে হবে। তেলাপিয়ার সারা দুনিয়ায় চাহিদা আছে। আমরা প্রচুর উৎপাদন করলেও সেই পরিমাণ রফতানি করতে পারছি না। যদিও কিছু কোম্পানি করছে, কিন্তু পরিমাণে নগণ্য। দেশের বাইরে বাজার খুঁজতে হবে এবং গুণগত মানও নিশ্চিত করতে হবে। হাইজেনিক নিশ্চিত হচ্ছে কিনা, যেখানে মাছ উৎপন্ন হচ্ছে সেখানে পানিতে ক্ষতিকর কিছু আছে কিনা, অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা, হেভি মেটাল আছে কিনা এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। উৎপাদন যদি ভালো মানের হয় তাহলে বিদেশে রফতানি করা যাবে। রফতানি করার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থাপনা দরকার, চাষীদের সেভাবে শেখাতে হবে। তাহলেই অ্যাকুয়াকালচার লাভজনক হবে।’

বাংলাদেশে কার্পজাতীয় মাছের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় রুই মাছ। সম্প্রতি মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের বিজ্ঞানীরা জিনগতভাবে উন্নত এক নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন। জি৩ হিসেবে পরিচিত জাতটির নতুন রুই মাছ চাষে সাফল্য পেয়েছেন চাষীরা, যার বর্ধনশীলতা বাজারে প্রচলিত রুইয়ের জাতের চেয়ে ৩৭ শতাংশ বেশি। বাজারে জাতটির ব্যাপক প্রচলন ঘটলে তা অ্যাকুয়াকালচারের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির গতিকে আরো বাড়িয়ে তুলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন চাষীরাও। তাদের ভাষ্যমতে, জাতটি মৎস্য চাষের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। পোনার পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলে ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারবেন মৎস্যচাষীরা। কারণ বাজারে সবসময় বড় রুই মাছের চাহিদা বেশি এবং দামও ভালো পাওয়া যায়।

গবেষকরা বলছেন, এটি সম্পূর্ণভাবেই দেশী রুই। হাইব্রিড প্রজাতিরও নয়। হালদা-পদ্মা ও যমুনা নদীর রুইয়ের মধ্য থেকে জিনগতভাবে সর্বোত্কৃষ্ট মাছের প্রজননের মাধ্যমে এ জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ কারণে জি৩-এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সাধারণ রুইয়ের চেয়ে বেশি। এটি প্রতিকূল পরিবেশেও ভালো বাড়ে। সাধারণ রুই যেখানে এক বছরে এক থেকে দেড় কেজির বেশি বড় হয় না, সেখানে ভালোভাবে যত্ন নিলে একেকটি জি৩ রুই তিন কেজি পর্যন্ত ওজন হয়। ২০২২ সালের মার্চ থেকে জুনে দেখা যায়, খুলনা বিভাগের ১০টি ও রাজশাহী বিভাগের নয়টিসহ মোট ১৯টি খামারেই তৃতীয় প্রজন্মের রুই সবচেয়ে বাড়ন্ত ছিল এবং প্রায় সব তৃতীয় প্রজন্মের রুই মাছ প্রচলিত জাতের রুই থেকে ৩৭ শতাংশ বেশি বেড়েছে।

মাছ চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণ জেলা যশোর। মাছ উৎপাদনে দেশে জেলাটির অবস্থান দ্বিতীয়। প্রতি বছর জেলাটিতে মাছ উৎপাদন বাড়ছে। যশোরে ২২ প্রজাতির মাছ চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় রুই মাছ। গত বছর রুই মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪৯ হাজার ৮৭০ দশমিক ৮৭ টন। নতুন জাত জি৩ রুই মাছ চাষে সাফল্য পাওয়া খামারি ফারুকুজ্জামান ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রথমে আমি একটি পুকুরে ট্রায়াল করেছিলাম কিন্তু ফলাফল এতটা ভালো হবে বুঝতে পারিনি। দুই মাসের মধ্যেই পার্থক্য বুঝতে পারি। এটি লোকাল হ্যাচারির পোনার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বাড়ে। একই পুকুরের মাছ জি৩ রুই বেশি বর্ধনশীল। ২০২২ সালের এপ্রিলে নতুন এ জাতের মাছের পোনা সংগ্রহ করে সেপ্টেম্বরে মাছ বিক্রি করি। এ পাঁচ মাসে ওজন হয়েছে সাড়ে তিন কেজি থেকে চার কেজি। অথচ এর আগের বছর হ্যাচারির প্রচলিত রুই মাছের পোনা চাষে পাঁচ মাসে ওজন হয়েছে দুই থেকে আড়াই কেজি।’

যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখানে ৭০ হাজার ২৯২ হেক্টর জমিতে মাছের উৎপাদন হচ্ছে। বছরে ৫০০ কোটি টাকার মাছ উৎপাদন হচ্ছে। এখানকার মাছ রফতানির পাশাপাশি সারা দেশে বিক্রি হচ্ছে। মাছ উৎপাদনে জড়িতদের সঙ্গে কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করছেন। খামারিদের বিভিন্ন ধরনের পরামর্শও দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাহবুবুল হক বলেন, ‘২০৪০ সালে সর্বমোট মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৮৬ লাখ টন। তবে আমাদের গুণগত মানের দিকে নজর দিতে হবে। আমরা যদি বহির্বিশ্বে আমাদের মাছ রফতানি করতে চাই, তাহলে চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করতে হবে। আমাদের সব কমপ্লায়েন্স দেখে চাষ করতে হবে। তেলাপিয়ার অনেক বড় বাজার রয়েছে বিশ্বে। উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। একই জায়গা থেকে দ্বিগুণ উৎপাদন করতে হবে কারণ আমাদের জলাশয় কমে যাচ্ছে। অ্যাকুয়াকালচারের ক্ষেত্রে উচ্চ উৎপাদনশীল জাত উদ্ভাবনের দিকে জোর দেয়া হচ্ছে। গত পরশু ওয়ার্ল্ডফিশ আমাদের হাতে রুই মাছের নতুন জাত জি৩-এর রেণু হস্তান্তর করেছে। আমরা যৌথভাবে কাজ করেছি। এ ধরনের মাছ যদি আমরা উৎপাদন করি তাহলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছবে। আমাদের মূল লক্ষ্য আধুনিক বিশ্বের মাছের চাহিদা ও দেশের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বাণিজ্যিক মাছ চাষ করা। ২০১৬ সালেই দৈনিক ৬৩ গ্রাম মাছের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। ২০৪০ সালে আমাদের টার্গেট দৈনিক আমরা ৮৫ গ্রাম মাছ খাব।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল