• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

বোরো উৎপাদনে রেকর্ড

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল ২০২৩  

দেশের উৎপাদিত মোট ধানের প্রায় ৬০ ভাগ আসে বোরো থেকে। এ কারণে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা আর বিশ্বা মন্দা মোকাবিলায় এবার বোরো মৌসুমে উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছিল সরকার। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ মেট্রিকটন চাল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বছর বোরোর যে ফলন হয়েছে তাতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি উৎপাদন হবে, যা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় রেকর্ড গড়বে।

কর্মকর্তারা জানান, সারা দেশে ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। ইতিমধ্যে হাওর এলাকার ৮০ ভাগ এবং অন্যান্য এলাকার ২০ ভাগ বোরো ফসল কেটে ঘরে তোলা হয়েছে। বাকি ফসল এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় কাটা শেষ হয়ে যাবে। হাওরসহ বিভিন্ন এলাকায় কম্বাইন হারভেস্টারে দ্রুত ধান কাটা হচ্ছে।


তবে বাম্পার ফলন হলেও কষ্টার্জিত ফসল ঘরে তোলার আগ পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছেন না কৃষকরা। প্রচ- তাপদাহের পর ঈদের দুই-তিন দিন আগে থেকে সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে কালবৈশাখীর তা-ব ও শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধানের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে তা সামগ্রিক আবাদের তুলনায় ক্ষতির পরিমাণ খুব একটা বেশি নয় বলে দাবি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের। অন্যদিকে বোরোর বাম্পার ফলন বাজারে ধানের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। ধান কাটার শ্রমিকের খরচ মেটাতে কোথাও কোথাও মাত্র ৮০০-৮৫০ টাকা মণ ধরে বিক্রি হচ্ছে ভেজা ধান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বোরো ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য এ বছর প্রায় ১৭০ কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। সারা দেশের ২৭ লাখ কৃষক এ প্রণোদনার আওতায় বিনামূল্যে বীজ ও সার পেয়েছেন। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বোরো ধানের ফলন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। স্বল্পজীবনকালীন ও ঠান্ডাসহিষ্ণু আগাম জাতের ধান চাষে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে ১৫ দিন আগেই ধান পাকছে।

হাওরভুক্ত সাত জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ বছর বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে। আর হাওর ও হাওরের বাইরে উঁচু জমি মিলে মোট বোরো আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে। এ সাত জেলায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪০ লাখ টন চাল। আর সারা দেশে ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে আবাদ হওয়া বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ১৫ লাখ মেট্রিকটন চাল। গত অর্থবছরে বোরো ধান আবাদ হয়েছিল ৪৮ লাখ ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে, উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ২ কোটি ২ লাখ টন চাল।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা ধানের অনেক জাত উদ্ভাবন করেছেন। এ জাতগুলো দ্রুত সম্প্রসারণ করতে পারলে হাওরের ধান ঘরে তোলা নিয়ে কোনো শঙ্কা থাকবে না। পানি আসার আগেই ঘরে ধান তোলা যাবে। বিশেষ করে ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের ধান চাষ না করার জন্য কৃষকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কারণ ব্রি ২৮ জাতটি পুরোনো হয়ে গেছে, সহজেই ব্লাস্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, উৎপাদনশীলতাও কমে গেছে। এবার হাওরে ধানের বাম্পার ফলন হলেও নেক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে ব্রি-২৮ ধানের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ব্রি-২৯ একটু দেরিতে পাকে। এসব জাতের পরিবর্তে উচ্চ উৎপাদনশীল নতুন জাত যেমন ব্রি-৮১, ব্রি-৮৯, ব্রি-৯২ চাষ করার জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করা হয়েছে। এতে ফলনও বেশি হয়েছে।


কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া সময়ের আলোকে বলেন, ফলন ভালো হওয়ায় আমরা আশা করছি, এবার বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি হবে। ধান কাটা শেষ হলে বলা যাবে কী পরিমাণ বেশি উৎপাদন হয়েছে। হাওর এলাকার ধান ৮০ ভাগ ইতিমধ্যে কাটা শেষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী দুর্যোগের আগেই বাকি ধান কাটা সম্ভব হবে। এটা হলে বোরো উৎপাদনে দেশ রেকর্ড গড়বে বলে আশাবাদী সরকার।

কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাকও বলেছেন, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ও সময়মতো ধান ঘরে তুলতে পারলে এ বছর বোরোতে রেকর্ড উৎপাদন হবে। কম্বাইন হারভেস্টারে দ্রুত ধান কাটা হচ্ছে। পাকা ধান দ্রুত কাটার জন্য ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে হাওরে কম্বাইন হারভেস্টার দেওয়া হয়েছে। এর সুফলও পাওয়া গেছে। গত কয়েক বছর ধরে দ্রুততার সঙ্গে ধান কাটা সম্ভব হওয়ায় হাওরের ধান নিয়ে শঙ্কা অনেকটা কমে এসেছে।

আসন্ন বোরো মৌসুমে সাড়ে ১৬ লাখ টন ধান ও চাল সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ মৌসুমে ৩০ টাকা কেজি দরে ৪ লাখ টন ধান এবং ৪৪ টাকা কেজি দরে ১২ লাখ ৫০ হাজার টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহ করা হবে। অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ৭ মে থেকে শুরু হয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলবে।

সময়ের আলোর সিলেট প্রতিনিধি দিপু সিদ্দিকী জানান, এবার সিলেটে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। তবে মাঠের পাকা-আধাপাকা সোনালি ধানের দুলুনি আনন্দের বদলে শঙ্কার ছায়া ফেলছে কৃষকের মনে। কারণ, গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় ফসলহানি আর আগের দুই বছরে করোনা সংক্রমণের কারণে ফসল গোলায় তেমন একটা ওঠেনি। এবার বন্যা ও করোনা না থাকলেও প্রকৃতির বৈরী আচরণে কৃষকরা আতঙ্কিত। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, ইতিমধ্যে সিলেট জেলার ৫০ শতাংশ বোরো ধান কাটা হয়ে গেছে। বৃষ্টি না থাকলে আগামী সপ্তাহের মধ্যেই ৮০ শতাংশ ধান কাটা হয়ে যাবে। অবশ্য আবহাওয়া অধিদফতর আগামী কয়েক দিন বজ্রসহ কালবৈশাখীর পূর্বাভাস দিয়েছে। ঈদের আগে প্রচ- কালবৈশাখী আর শিলাবৃষ্টিতে হাকালুকি হাওরসংলগ্ন ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার উপজেলার বোরো ধানের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে তা সামগ্রিক আবাদের তুলনায় খুব একটা বেশি নয় বলে দাবি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের।


বিয়ানীবাজারের কৃষক খায়রুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক দিন আগে শিলাবৃষ্টিতে তাদের ১১ কিয়ার (১ কিয়ার=১০০ শতক) জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। গত বছর বন্যায় সমপরিমাণ জমির ধান তলিয়ে যায়। এ বছরও ধান হারিয়েছি। শুধু আমরা না, হাকালুকিপারের অনেকের পাকা ধান শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ফেঞ্চুগঞ্জের কৃষক জামাল মিয়া বলেন, শিলাবৃষ্টিতে ধানের বেশ ক্ষতি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাগাদাও আছে দ্রুত ধান কেটে নেওয়ার। যেগুলো বেচে গেছে পাকা-আধাপাকা মিলিয়ে দ্রুত কেটে নিচ্ছি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, সিলেটের উপ-পরিচালক (শস্য) মো. ফারুক হোসেন বলেন, সিলেটে এবার ৮৪ হাজার ৪৫০ হেক্টর বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে ৮৫ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে। প্রকৃতির বৈরিতার কারণে আমরা কৃষকদের দ্রুত ধান কাটার পরামর্শ দিচ্ছি। গত ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৫০ শতাংশ জমির বোরো ধান কাটা হয়েছে। হাওর এলাকায় মোট আবাদের ৬৭ শতাংশ এবং হাওর ছাড়া অন্য এলাকায় মোট আবাদের ৩৭ শতাংশ বোরো ধান কাটা হয়ে গেছে। ঝড়বৃষ্টি না থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে ৮০ শতাংশ ধান কাটা হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহে ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস নেই। ফলে নির্বিঘ্নে কৃষকরা ধান কাটতে পারবেন।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এ কথার সঙ্গে আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবহাওয়া অধিদফতর আগামী সপ্তাহে সিলেট অঞ্চলে বজ্রসহ ঝড়ো হাওয়া, কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে। সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. সজিব হোসাইন বলেন, আগামী কয়েক দিন সিলেটে কালবৈশাখী ও ঝড়ো হাওয়াসহ বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, হাওরে নামার আগে কৃষকরা আবহাওয়া অফিস থেকে পূর্বাভাস জেনে নিতে পারেন। আকাশে কালোমেঘ দেখলে বজ্রপাতের পূর্বাভাসও ধরে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে গেলে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়াতে দ্রুত পাকা ধান কাটতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি নূর মোহাম্মদ জানান, কিশোরগঞ্জের হাওরে বোরো মৌসুমে ধান কাটার ধুম পড়েছে। ধান কাটা, মাড়াই আর পরিবহনে ব্যস্ত সময় পার করছেন হাওরের কৃষকরা। এবার হাওরে ধানের বাম্পার ফলন হলেও নেক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে ব্রি-২৮ ধানের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। হাওরের মাঠে মাঠে এখন সোনালি ধানের সমারোহ। পাকা ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষক আর কৃষি শ্রমিকেরা। কাস্তের পাশাপাশি ধান কাটা হচ্ছে কম্বাইন হারভেস্টারে। নানা প্রতিকূলতার পরও ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার শ্রমিক হাওরে এসেছেন ধান কাটতে।

জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে প্রধান তিনটি সম্পূর্ণ হাওর অধ্যুষিত উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এই তিন হাওরে দিনভর চলছে ধান কাটা। বিভিন্ন হাওর ঘুরে দেখা গেছে, অনেক এলাকায় ধান পেকে গেলেও শ্রমিক সংকটে কাটতে বিলম্ব হচ্ছে। বেশি টাকা দিয়েও কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। তবে জেলার বেশিরভাগ এলাকায় ধান কাটা শেষের দিকে। হাওরের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত করিমগঞ্জ উপজেলার চামড়াঘাটে প্রতিদিন শত শত নৌকা বোঝাই করে ধান আসছে। এসব ধান সড়কপথে পরিবহন করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

কৃষি বিভাগ বলছে, ব্রি-২৮ ছাড়া এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সময়মতো ধান কাটা শেষ হবে এবং ভালোয় ভালোয় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধান গোলায় তুলতে পারবেন বলে আশা করছেন তারা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. আবদুস সাত্তার জানান, হাওরে দ্রুত ধান কাটা চলছে। মাড়াই কল, পাওয়ার থ্রেসার ও কাস্তে দিয়ে কৃষকরা ধান কাটছেন। এরই মধ্যে ৭০ ভাগ জমির ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। ৩০ ভাগ বাকি আছে। এসব ধান কাটতে আরও অন্তত ১৫ দিন লাগবে।

কৃষকরা বলছেন, শ্রমিক খরচ মেটাতে গিয়ে অনেকেই ভেজা ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। চামড়াবন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় শত শত আড়তে ধান বেচাকেনা হচ্ছে। মাত্র ৮০০-৮৫০ টাকা মণ ধরে বিক্রি হচ্ছে ভেজা ধান। কৃষকরা জানান, সরকার ১২০০ টাকা মণ ধরে ধান কিনবে বলে ঘোষণা দিলেও তারা এর সুফল পান না। জমি থেকে বাড়িতে এনে ধান শুকানোর পর আবার পরিবহন করে সরকারি গুদামে নেওয়ার পর নানা ঝামেলায় পড়তে হয় তাদের। নানা অজুহাতে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরিমাণমতো ধান বিক্রি করার সুযোগও পান না। তাই কম দামেই তাদের ধান বিক্রি করতে হয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, এবার কিশোরগঞ্জে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ লাখ ১৬ হাজার ২১০ মেট্রিকটন। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা কৃষি বিভাগের।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল