• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

জামালপুরের প্রথম শহীদ মিনার ও তার ইতিহাস

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

১৯৫০ সালের শেষ দিকে তৎকালীন জামালপুর মহকুমা শহরে ভাষা আন্দোলন সাংগঠনিক রূপ নেয়। ঐ সময় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ও মূলনীতি কমিটির সুপারিশ বাতিলের দাবিতে ওই বছরের ১১ নভেম্বর ডাকা হরতালের হাওয়া তৎকালিন জামালপুরেও লাগে। মূলত সেই ১১ নভেম্বরের ডাকা হরতালের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে জামালপুরের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গঠিত হয় ‘জামালপুর মহকুমা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।

 

ওই পরিষদের সভাপতি ছিলেন অ্যাডভোকেট তৈয়ব আলী, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ ছিলেন যথাক্রমে আশেক মাহমুদ কলেজের শিক্ষক জহুরুল ইসলাম ও সুজায়াত আলী, সহসাধারণ সম্পাদক ছিলেন মহকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান মতি মিয়া।

 

এ ছাড়া আশেক মাহমুদ কলেজ ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সৈয়দ আব্দুস সোবহানের নেতৃত্বে ওই পরিষদের সঙ্গে সাধারণ ছাত্ররাও আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন।

 

জামালপুরে ভাষা আন্দোলনের উজ্জ্বল ইতিহাস থাকলেও তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের রোষের কারণে ভাষাশহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণে বেশ বেগ পেতে হয়। মনোয়ার হুসেন মুরাদ ও ইতিমদদৌলা হিন্দোল সম্পাদিত ‘ভাষা আন্দোলনে জামালপুর’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালের পর প্রতিবছর শহীদ দিবস পালিত হলেও তৎকালীন প্রশাসনের বৈরিতার কারণে স্থায়ী কোনো শহীদ মিনার স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন স্থানে কাঠ বা কলাগাছ দিয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে শহীদ মিনার তৈরি করে তাতে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সংস্কৃতি চালু থাকে।

 

এরপর তৎকালীন প্রগতিশীল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু আশেক মাহমুদ কলেজ থেকেই প্রথম শহীদ মিনার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কলেজের বড় পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোনায় ১৯৬৩ সালে জামালপুরের প্রথম শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষ সুজায়াত আলী কলেজ ছাত্রসংসদের সহসভাপতি (ভিপি) এস এম সাত্তার, জিএস সামিউল হক, ছাত্রনেতা মো. শাহনেওয়াজ, মোখলেছুর রহমান আনছারী প্রমুখ প্রথম কয়েকটি ইট দিয়ে শহীদ মিনারের বেদির ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করেন। পরে ছাত্রসংসদ নেতা ওয়াহেদুজ্জামান সেখানে স্তম্ভ স্থাপন করেন।

 

জামালপুরের প্রথম এ শহীদ মিনার নিয়ে তৎকালীন মহকুমা কর্মকর্তার (এসডিও) সঙ্গে কলেজ কর্তৃপক্ষের বেশ বিরোধ তৈরি হয়। এমনকি শহীদ মিনার নির্মাণ করলে কলেজের মঞ্জুরি বাতিলের হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভাষাসৈনিক ও কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা সেই হুমকি উপেক্ষা করেই শহীদ মিনার নির্মাণ শুরু করেন। তাঁরা নিজেদের মধ্য থেকে চাঁদা তুলে ছোট আকারের শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। ১৯৬৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার পর সেখানে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো শুরু হয়। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সেই শহীদ মিনারেই প্রভাতফেরি শেষে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হতো। কিন্তু একাত্তর সালে যুদ্ধের সময় শহীদ মিনারটি ভেঙেচুরে যায়।

 

পরে ১৯৭৩ সালে ছাত্র ইউনিয়ন দয়াময়ীপাড়া শাখা ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মণিমেলা খেলাঘর আসরের কর্মীরা স্থানীয় পুনাই পার্কে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপনের উদ্যোগ নেন। পরে জামালপুর পৌরসভার উদ্যোগে সেখানে স্থানীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। সম্প্রতি সেই শহীদ মিনারটি সরিয়ে দয়াময়ীপাড়ায় নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লী প্রকল্পভুক্ত করে স্থাপন করা হয়েছে বেশ বড় আকারের দর্শনীয় শহীদ মিনার।

 

‘ভাষা আন্দোলনে জামালপুর’ গ্রন্থের লেখক সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনোয়ার হুসেন মুরাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কলেজের পুকুরপাড়ের প্রথম শহীদ মিনারটি জামালপুরের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য বিষয়। স্থানটি সংরক্ষণ করা দরকার।’

 

জামালপুরের ভাষা ও মুক্তিসংগ্রাম গবেষণাকেন্দ্রের সদস্যসচিব প্রভাষক আশরাফুজ্জামান স্বাধীন বলেন, ‘সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের পুকুরপাড়ে জামালপুরের প্রথম শহীদ মিনারটি জামালপুরের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সাক্ষী। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ৫৭ বছরেও সেখানে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়নি। এটি সংরক্ষণ, নতুন শহীদ মিনার স্থাপন এবং সেখানে প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো দরকার।’

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল