• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

আপনার বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী স্পাইডার-ম্যান

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল ২০২০  

পিটার পার্কার একেবারের সাদাসিধে গোবাচারা ছেলে। স্কুলে কোন ঝুটঝামেলাতে যায় না। বেচারা ছেলেবেলা থেকেই অনাথ। জেঠা বেন আর জেঠিমা মে-র কাছে মানুষ। স্কুলে ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা, কথা কম বলা, ছেলেটিকে তেমনভাবে কেউ চেনেও না, পাাাত্তাও দেয় না। পিটারও নিজের মতো থাকে। একদিন স্কুলের বিজ্ঞান পরীক্ষাগারে দুর্লভ প্রজাতির এক মাকড়সা কামড় দিল তাকে। 

 

আর তারপরেই ঘটতে লাগল অদ্ভুত সব ঘটনা। পিটার লক্ষ করল, তার মাঝে মাকড়সার মতো নানা শক্তির উদ্ভব ঘটেছে। তার শারীরিক শক্তি, দ্রততা, ক্ষিপ্রতা, বেড়ে যাচ্ছে বেশ কয়েক গুণ। মাকড়সার মতোই দেওয়াল বেয়ে উঠতে বা দেওয়ালে সেঁটে থাকতে কোন অসুবিধাই হচ্ছে না তার। আর সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেটাকে স্পাইডার সেন্স বলা হয়, যা আগাম বিপদের পূর্বাভাস দেয়। ল্যাবরেটরিতে বসে গবেষণা করে সে বানিয়ে ফেলে এক তরল যা মাকড়সার রসের মতো, বাতাসের সংস্পর্শে আসলেই তা পরিণত হবে শক্ত, দৃঢ় সুতোতে। সেই তরল নিক্ষেপের জন্য পিটার কব্জিতে বাঁধা একটি জাল ছুড়বার যন্ত্রও আবিষ্কার করে। অবশেষে গায়ের সাথে চামড়ার মতো লেগে-থাকা নীল—লাল কস্টিউম আর মণিহীন সাদা চোখওয়ালা মুখোশে নিজেকে ঢেকে শুরু হল পিটারের নতুন জীবন। পৃথিবী তাকে চিনল স্পাইডারম্যান নামে।

 

প্রথমদিকে নিজের সক্ষমতাআর সাহায্যে টেলিভিশনে কায়দা দেখিয়ে বেশ কয়েক পয়সা আয় করছিল পিটার। একদিন সব ওলটপালট হয়ে গেল। স্টুডিওতে আসা এক ছিনতাইকারী পিটারের হাত থেকে পালিয়ে গেল। পরে সেই খুন করে পিটারের প্রিয়তম জেঠা বেনকে। এতদিন যে শক্তিকে পিটার একেবারেই সিরিয়াসলি নেয়নি, রাতারাতি সে যেন উন্নীত হল নিষ্পাপ কিশোর থেকে বাস্তবের মাটিতে পা রাখা যুবকে। একটা মৃত্যু কত কিছুই না পাল্টে দেয়! পিটার বোঝে ‘মহান শক্তির সাথে মহান দায়িত্বও আসে’ (With Great Power, There Must Also Come Great Responsibility) ।

 

১৯৬২ সালে এই স্পাইডার-ম্যানের আইডিয়া প্রথম আসে কমিকস লেখক স্ট্যান-লির (২০১৮ সালে প্রয়াত) মাথায়। প্লটে সাহায্য করেন জ্যাক কার্বি আর আঁকিয়ে স্টিভ ডিটকো। ১৯৬৩ এর মার্চ মাস থেকে The Amazing Spider-Man প্রকাশ শুরু হয়। আজও তার জনপ্রিয়তার ধারা অব্যাহত। ব্যাটম্যান ও সুপারম্যানের সাথে এক নিশ্বাসে তার নামও উচ্চারিত হয়।

 

স্পাইডার-ম্যানের আকর্ষণ মূলত পিটার পার্কারের চরিত্রের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। সে এক কিশোর। নিজের প্রিয়তম মানুষটির মৃত্যু রাতারাতি তাকে ঘাড় ধরে পরিচয় করায় পৃথিবীর অন্ধকার দিকের সাথে। ব্যাটম্যানের মতো সেও ব্রত নেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ার। কিন্তু ব্যাটম্যানরূপী বেশ কয়েক বছর সময় পেয়েছে নিজেকে তৈরি করার। তার পিছনে ছিল ওয়েন ম্যানরের বিশাল ঐশ্বর্য। কিন্তু পিটারের এসব কিচ্ছু নাই। আছে শুধু অলৌকিক কিছু অতিমানবিক ক্ষমতা-যার বলে জেঠা বেনের মৃত্যুর পরপরই সে নেমে পড়ে দুষ্টের দমনে। কিন্তু অর্থের দিক থেকে নিম্ন –মধ্যবিত্ত এক কিশোরের মাথায় এই পৃথিবী উদ্ধারের দায়িত্ব যে কী ভয়ানক, তা সহজেই অনুমেয়। স্পাইডার-ম্যনের চরিত্রের এই কিশোরসুলভ মননি আমাদের আকর্ষণ করে। সে সুপারম্যানের মতো আবেগহীন বা ব্যাটম্যানের মতো দৃঢ়চেতা নয়।

 

সেও (পিটার পার্কার/স্পাইডার-ম্যান) আমাদের সবার মতো দুঃখে ভেঙ্গে পড়ে, উদ্বেল হয়, এমনকি কাঁদেও। একবার জেঠি মে অসুস্থ হলে পিটার তাকে রক্ত দেয়। সেই রক্তে আরও অসুস্থ হয়ে যায় মে। 

 

তাকে সারানোর সিরাম আছে স্পাইডার-ম্যানের সবচেয়ে বড় শত্রু ড. অক্টোভাসের কাছে। তারই সন্ধানে স্পাইডার-ম্যান সেজে বেরিয়ে পড়ে পিটার। নানা বিপদ ঠেলে, ধ্বংসস্তুপের নীচে চাপা পড়েও কোনক্রমে সিরাম উদ্ধার করে মে-কে বাঁচায় পিটার-তখনও সে কলেজে ভর্তি হয়নি।

 

শুধু বেন জেঠাই নয়, মৃত্যুকে বারবার খুব কাছ থেকে দেখতে হয়েছে পিটারকে। তার খুব কাছের লোকেরা একের পর এক মারা গেছে চোখের সামনে। পিটারকে অত্যন্ত স্নেহ করত যে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ক্যাপ্টেন জর্জ স্টেসি, সে ড. অক্টোপাসে সাথে স্পাইডার-ম্যানের যুদ্ধকালীন ধসে-পড়া এক বাড়ির তলায় দাঁড়ানো একটি শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যু ঘটে। জর্জের কন্যা গোয়েন ভালবাসত পিটারকে। গ্রিন গবলিনের সাথে স্পাইডার-ম্যানের যুদ্ধকালীন তার মৃত্যু ঘটে। এই গ্রিন গবলিনও কিন্তু পিটারের খুব কাছের মানুষ। পিটারের প্রিয় বন্ধু হ্যারির বাবা নর্মান অসবোর্ন এক রাসায়নিক দুর্ঘটনায় সবুজ দানবে রূপান্তরিত হয়, যাকে আমরা গ্রিন গবলিন নামে চিনি। এভাবেই প্রিয়তম লোকেরা একে একে দূরে চলে গেছে পিটারের। মাঝে মাঝে সে ভেবেছে আর না, এবার সবকিছু ছেড়েছুড়ে সাধারণ মানুষের মতো জীবন কাটাবে। কিন্তু তার পরপরই ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীতে তাকে আবার মুখে মুখোশ এটে নেমে পড়তে হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। তার তো বিশ্রাম নিলে চলবে না।

 

স্পাইডার-ম্যানের কমিকস সর্বদা বাস্তবের সামাজিক সমস্যাগুলোকে তুলে ধরেছে পাঠকের কাছে। ’৬০-’৭০ দশকের আমেরিকার কলেজের নানা সমস্যা উঠে এসেছে পাতায় পাতায়। ১৯৭১-এ পিটারের বন্ধু হ্যারির মাদকাসক্ত হওয়ার কথা জানা যায়, ১৯৮২-র একটি সংখ্যার বিষয় ছিল আমেরিকার কলেজগুলোতে বন্দুকের অনুপ্রবেশ। ১৯৭৪-এ স্পাইডার-ম্যান জোট বাঁধে দ্যা পানিশারের সাথে। দুইজনে মিলে লাতিন আমেরিকার একনায়ক টারানটুলাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। 

 

স্পাইডার-ম্যানকে বাস্তবের পটভূমিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে লেখক জে• মাইকেল স্ট্রাকজিনস্কি। তার পিটার যেন আরও বেশি মানবিক গুণে ঋদ্ধ। স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ হয়েছে তার। সে এখন শিক্ষক।

 

 তার পুরানো স্কুলে ফিরে গিয়ে সে দেখে স্কুল-পাড়া সবকিছুই পাল্টে গেছে। ছাত্রদের সে শেখায় উন্নত মানুষ হতে। সে বুঝতে পারে এতকাল গৃহহীন, কর্মহীন ভবঘুরে কিশোরদের নিয়ে ভাবেই নি। 

 

অপরাধীদের শাস্তি দিয়েছে, কিন্তু যাতে কেউ অপরাধের পথে না যায়, সে চেষ্টা করেনি। তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত। ২০০৬-এর সিভিল ওয়্যার সিরিজে তো আর নিজেকে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রাখতে পারেনি। মুখোশ খুলে সারা বিশ্বকে নিজের পরিচয় দিয়ে দিয়েছে। আর তার পরেই বুঝতে পেরেছে কী ভুলটাই না সে করেছে। জেঠি মে’কে গুলি মারে ভিলেন। কোমায় চলে যায় মে। তাকে বাঁচাতে শয়তানের সাথে চুক্তি করে পিটার আর তার প্রাক্তন স্ত্রী মেরি জেন। শয়তান সময়কে পিছিয়ে নিয়ে যায় তখন, যখন পিটার আর মেরির বিয়ে হয়নি, মৃত বন্ধু হ্যারি বেঁচে ছিল, বেঁচে ছিল মে। সবার মাথা থেকে মুছে যায় পিটারের মুখোশ খোলার কথা।

 

আসলে পিটার পার্কার এমনই। পিটার প্যানের মতো সেও চিরকিশোর। সে ভুল করে, সে আবেগে ভাসে, সে অসম্ভবকে সম্ভব করতে চায়। ব্যথা পায়। কিন্তুয়াবার উঠে দাঁড়ায়। তার কারণ সে জানে তার সংকল্প পবিত্র। দায়িত্ব পবিত্রতর। আর পবিত্রতম-তার হৃদয়।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল