• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

LDC থেকে উত্তরণে প্রস্তুত বাংলাদেশ?

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০২০  

বাংলাদেশ একটি স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি এবং খুব সম্ভবত ২০২৪ সালে আর এই কাতারে থাকবে না। আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে উন্নতি হচ্ছে- এমন নানা বিবেচনায় ২০১৮ সালে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বা সিডিপি বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্য বলে ঘোষণা করে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিডিপি তাদের ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনার সময় নির্ধারণ করেছে। এবারের পর্যালোচনায় যোগ্য হলে সিডিপি বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করবে। 
সিডিপির এবারের পর্যালোচনার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কেননা করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। সব পক্ষের পূর্বাভাসই বলছে, বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্য আগের অবস্থায় ফেরত আসতে দীর্ঘ সময় লাগবে। অবশ্য কভিড-১৯ এর আগেও চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বিরোধের কারণে বিশ্ববাণিজ্যে অনিশ্চয়তা বেড়ে গিয়েছিল। সিডিপির পর্যালোচনার আগে একটি প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে ক্ষতি বিবেচনায় বাংলাদেশ কি এলডিসি থেকে উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন করবে? যতদূর জানা গেছে, বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত এ জাতীয় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।  ফলে আমরা কতটুকু প্রস্তুত সেই আলোচনাই এখন মুখ্য। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ ইউরোপীয়  ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানিতে পুরোপুরি শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা পায়। বিভিন্ন প্রাক্কলন বলছে, সুবিধা উঠে গেলে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ শুল্ক্ক বাড়তে পারে। এ ছাড়া ওষুধ উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব সংক্রান্ত বিধিবিধান থেকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আমাদের অব্যাহতি দিয়েছে। এলডিসি থেকে বের হলে এই অব্যাহতি থাকার কথা নয়। বাণিজ্যের বাইরে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের নমনীয় অর্থাৎ কম সুদের ও শর্তের ঋণ কমবে। 
ইইউতে এভরিথিং বাট আর্মস বা ইবিএ সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ এখন অস্ত্র ছাড়া সব পণ্য শুল্ক্ক ছাড়া রপ্তানি করে। এলডিসি থেকে উত্তরণের তিন বছর পর্যন্ত অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা থাকবে। ইইউর জিএসপি প্লাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। তবে এর জন্য কঠিন কিছু শর্ত রয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, কার্বন নিঃসরণ কমানোসহ কিছু বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত দেখে তারা এ সুবিধা দেবে। জিএসপি প্লাস না পেলে বড় ধরনের সংকটে পড়বে রপ্তানি খাত। আমাদের বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, ভিয়েতনামের সঙ্গে ইইউর মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) ফলে ২০২৭ সালে ওই অঞ্চলে ভিয়েতনামের ৯৯ শতাংশ পণ্য শূন্য শুল্ক্কে রপ্তানি হবে। অন্যদিকে একই বছর থেকে আমাদের তৈরি পোশাকে ওই বছর থেকে প্রায় ১০ শতাংশ শুল্ক্ক আরোপ হতে পারে। 
ওপরের তথ্য-উপাত্ত থেকে সহজেই অনুধাবণযোগ্য, এলডিসি থেকে উত্তরণকে সামনে রেখে আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ফলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরিকল্পিতভাবে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগোতে পারছি কিনা সেই আলোচনা এখন বেশি হওয়া প্রয়োজন। আমাদের অষ্টম পঞ্চমবার্ষিক পরিকল্পনা এখন চূড়ান্ত হওয়ার পথে। এসডিজি বাস্তবায়নকাল চলছে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনারও বাস্তবায়ন হচ্ছে। জাতীয় এসব পরিকল্পনার সঙ্গে এলডিসি উত্তরণকে আমরা কতটুকু সন্নিবেশ করতে পারছি, তার ওপর নির্ভর করবে আমাদের প্রস্তুতির মাত্রা। শুধু তাই নয়, সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ জোরদার না হলে তা টেকসই হবে না।
এবার সম্ভাবনার প্রসঙ্গে আসি। এলডিসি থেকে বের হলে আমাদের লাভ কি? লাভের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, বাংলাদেশের বড় ধরনের ব্র্যান্ডিং হবে। এখানকার অর্থনীতি  উদীয়মান, এখানে বড় বাজার সৃষ্টি হচ্ছে- এমন বার্তা আন্তর্জাতিকভাবে যাবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের অন্যতম শর্ত হলো অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া। বাংলাদেশ এ শর্ত পূরণ করতে পেরেছে- যার অর্থ দাঁড়ায়  অর্থনীতিতে ঝুঁকির মাত্রা কম। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বাড়ছে মানে এখানে অভ্যন্তরীণ বাজার বড় হচ্ছে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়বে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ তুলনামূলক বিচারে অনেক কম। বছরে মাত্র তিন বিলিয়ন ডলারের মতো। বড় আকারের বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়মকানুন আরও সহজ করা, অবকাঠামোর ঘাটতি পূরণ করা, রপ্তানিতে লিড টাইম কমানো, করছাড়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা দ্রুততর করাসহ নানা উদ্যোগে দৃশমান অগ্রগতি করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ র‌্যাংকিংয়ে ডুয়িং বিজনেস র‌্যাংকিংয়ে আমাদের অবস্থান ১৬৮, যা সারাবিশ্বের মধ্যে শেষের দিকে। এখানে দৃশ্যমান উন্নতি হতে হবে। মোট কথা, আমাদের যে সম্ভাব্য ক্ষতি হবে তা পূরণের মাত্রা নির্ভর করছে এলডিসি থেকে বের হলে বিভিন্ন সুযোগকে কীভাবে কাজে লাগাতে পারছি তার ওপর। 
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশকে এলডিসি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে জাতিসংঘ। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ৪৭টি দেশ এই শ্রেণিতে। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ এলডিসি ক্যাটাগরি প্রতিষ্ঠা করে। এ পর্যন্ত ৫২টি দেশ এ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বোতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, মালদ্বীপ, সামোয়া এবং ইকয়েটোরাল গিনি- এই পাঁচটি দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের আগে বোতসোয়ানা কর-জিডিপি অনুপাত  ৫০ শতাংশে উন্নীত করে। আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত এখনও ১০ শতাংশের নিচে।  যারা এলডিসি থেকে বের হয়েছে, তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কয়েক বছর কমে গিয়েছিল। বৈদেশিক সাহায্যও কমে গিয়েছিল। অন্যদিকে  কর-জিডিপি অনুপাত এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই বেড়েছিল। সুতরাং কর সংগ্রহ এবং এফডিআই ব্যাপকভাবে বাড়ানো না গেলে আমাদের উত্তরণ মসৃণ হবে না। 
জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির সদস্য বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় বলেছেন, স্বল্পোন্নত দেশের  পর্যায় থেকে বাংলাদেশের বের হওয়ার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী কৌশল বা কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে এলডিসি থেকে উত্তরণের ওই কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় এবং বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
এ ছাড়া উত্তরণের পরও যাতে এলডিসি হিসেবে বাণিজ্যে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা এবং অন্যান্য অগ্রাধিকার একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে, তার জন্য অন্য দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে  আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। 

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল