• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

জেনে নিন ইয়াজূজ-মাজূজের পরিচয়

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১৪ জুন ২০২০  

মুসলমানদের কাছে খুবই পরিচিত নাম ইয়াজূজ-মাজূজ। পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় এবং বুখারি, মুসলিমসহ বহু হাদিসের কিতাবে এদের আলোচনা রয়েছে। তবে কোনো ভালো গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কারণে নয়। বরং ইয়াজূজ-মাজূজ ও বর্বরতা সমার্থবোধক শব্দ। 

 

কেয়ামতের আগে এই জাতির আবির্ভাব ঘটবে। মূল গোষ্ঠীটির আত্মপ্রকাশ কেয়ামতের আগে হলেও, তার কোনো কোনো অংশের আত্মপ্রকাশ আগেও হতে পারে কিনা তা নিয়ে মতবিরোধ চলে আসছে। বর্তমান চীনা ও রাশিয়ানদেরকেও কেউ কেউ তাদের অন্তর্ভূক্ত মনে করেন। এই লেখায় সে ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। তোলে ধরা হয়েছে ইতিহাসবেত্তা, মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরদের বক্তব্য। 

 

আল কোরআনে কেয়ামতের পূর্বে কাফেরদের পুনরায় ফিরে আসার অসম্ভ্যতা বুঝানোর জন্য বলা হয়েছে, ‘যে জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি তারা ফিরে না আসা অবধারিত। যে পর্যন্ত না ইয়াজূজ-মাজূজকে বন্ধনহীন করে দেয়া হবে এবং তারা প্রত্যেকে উচ্চভূমি থেকে দ্রুত ছুটে আসবে।’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত নম্বর-৯৬)। 

 

তাদের ফিরে আসা তখনই হবে যখন ইয়াজূজ-মাজূজকে খোলে দেয়া হবে। দুনিয়ার জীবনে কারো ফিরে আসা সম্ভব নয়। তাই ইয়াজূজ-মাজূজের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর গোটা মানব জাতিকে ওঠানো হবে। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, ইয়াজূজ-মাজূজের আবির্ভাব কেয়ামতের আগে হবে। সহিহ মুসলিমে হজরত হুযাইফা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,  ‘আমরা কয়েকজন সাহাবি একদিন পরস্পর আলোচনা করছিলাম। ইতোমধ্যে রাসূল (সা.) আগমন করলেন। এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি নিয়ে আলোচনা করছো? আমরা বলি, কেয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছি। রাসূল (সা.) বলেন, কেয়ামত সংগঠিত হবে না, যে যাবত না দশটি আলামত প্রকাশ পায়। দশটির মাঝে তিনি ইয়াজূজ-মাজূজের আত্মপ্রকাশও উল্লেখ করেন।’ (মাআরিফুল কোরআন , সূরা আম্বিয়া, আয়াত নম্বর: ৯৬)। তাই কেয়ামতের আগে ইয়াজূজ-মাজূজের আত্মপ্রকাশ ঘটবে এটা নিশ্চিত। তবে এদের আত্মপ্রকাশ কেয়ামতের আগে একবারই হবে নাকি তাদের কিছু কিছু আগেই দুনিয়াতে আসবে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। এ সম্পর্কে আলোচনা পরে আসছে।

 

ইয়াজূজ-মাজূজের পরিচয়:

 

কোরআন ও হাদিসের আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, তারাও মানব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। আমাদের মতো তারাও হজরত নুহ (আ.) এর বংশধর। আমরা জানি, হজরত নুহ (আ.) এর পর দুনিয়াতে যারাই এসেছে, তারাই হজরত নুহ (আ.) এর বংশের। ঐতিহাসিক ও দুর্বল কিছু বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত যে, তারা হজরত নুহ (আ.) এর ছেলে ইয়াসাফের বংশধর। তাদের সংখ্যা হবে অসংখ্য। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তারা বিশ্বের বুকে আছড়ে পড়বে। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর সেদিন আমি তাদেরকে দলে দলে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ছেড়ে দেবো।’ (সূরা: কাহাফ, আয়াত: ৯৯)।

 

ইয়াজূজ-মাজূজের আবির্ভাবের সময়:

 

ইয়াজূজ-মাজূজের আবির্ভাব কখন হতে পারে, এর বিস্তারিত আলোচনা হাদিসের ব্যাখ্যাগুলোতে এসেছে। হজরত জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.) ছিলেন রাসূল (সা.) স্ত্রী। তিনি বলেন, এক রাতে রাসূল (সা.) জেগে বলতে লাগেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ আরব জাতির ধ্বংস ওই বিপদের দ্বারা, যা সন্নিকটে। আজকে-ইয়াজূজ মাজূজের প্রাচীরের এই পরিমাণ খোলে দেয়া হয়েছে (তারপর তিনি আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করে পরিমাণ বুঝালেন)। হজরত জয়নব (রা.) বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মাঝে নেককার লোকেরা থাকাবস্থায়ও কি আমরা ধ্বংস হতে পারি? রাসূল (সা.) বলেন, হ্যাঁ! যখন তোমাদের মাঝে ব্যভিচার, হারাম এবং গোনাহ ও অশ্লীলতার ছড়াছড়ি হবে। (সহিহ মুসলিম-৭১৯১)।

 

এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, ইয়াজূজ-মাজূজের প্রাচীর রাসূল (সা.) এর সময়েই আংশিক খোলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইমাম তিরমিজি (রহ.) সুনানে তিরমিজিতে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন, যা এই হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। হাদিসটি হচ্ছে, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘ওরা প্রাচীর থেকে বের হওয়ার জন্য প্রতিদিন খনন কাজ করে যাচ্ছে। কাজ সম্পন্ন হওয়ার কাছাকাছি এসে গেলে, তাদের সর্দার নির্দেশ জারি করে, তোমরা আজকের মতো ফিরে এসো! আগামীকাল আবার কাজ শুরু হবে। পরের দিন তারা আরো বেশি শক্তি নিয়ে ফিরে আসে। যখন তাদের বের হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসবে এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তা হবে তখন তাদের সর্দার বলবে, তোমরা আজকের মতো ফিরে এসো! আগামীকাল ইনশাল্লাহ আমরা খনন করে বের হতে পারবো। অতীতে ফিরে আসার পর প্রাচীর তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতো। কিন্তু ওই দিন গিয়ে দেখবে কাজ যেখানে রেখে এসেছিলো সেখানেই আছে। (সুনানে তিরমিজি-৩১৫৩)।

 

প্রথম হাদিসে বক্তব্য অনুযায়ী রাসূল (সা.) এর যুগেই প্রাচীরের আংশিক খোলে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় হাদিস দ্বারা বুঝা যায় কেয়ামতের আগে খোলার ব্যবস্থা হবে। এই দুই হাদিসের মাঝে সমন্বয়ের জন্য, কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেছেন, দ্বিতীয় হাদিসটি দুর্বল। অর্থাৎ ইয়াজূজ-মাজূজের প্রাচীর আংশিক খোলে দেয়া হয়েছে এটাই বাস্তব। তবে আল কোরআনের সূরা কাহাফে এসেছে, ‘অতঃপর ইয়াজূজ-মাজূজ ওই প্রাচীরের উপর আরোহন করতে পারলো না এবং তা ভেদ করতেও সক্ষম হলো না। যূলকারনাইন বলেন, এটা আমার রবের অনুগ্রহ। যখন আমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুত সময় এসে যাবে, তিনি এটাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন।’ (আয়াত নম্বর: ৯৯)। 

 

মুফাসসিরা ‘প্রতিশ্রুত সময়’ এর ব্যাখ্যা করেছেন ওকয়ামত দিবস দ্বারা। অর্থাৎ কেয়ামত যখন সন্নিকটে থাকবে তখন ইয়াজূজ-মাজূজের প্রাচীর খোলে দেয়া হবে। তবে বর্তমান সময়ের বিজ্ঞ আলেমদের মতে উভয়টি সঠিক। অর্থাৎ ইয়াজূজ -মাজূজের প্রাচীরের আংশিক খোলে দেয়া হয়েছে। তবে তাদের মূল সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হবে কেয়ামতের আগে। এ ব্যাপারে আমাদের উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী বলেন, ‘ইয়াজূজ মাজূজের আবির্ভাব বার বার হতে থাকবে। কোরআনে এ কথা স্পষ্ট করেনি যে, প্রাচীর দ্বারা তাদেরকে সব দিক থেকে বেষ্টন করে ফেলা হয়েছে। আর প্রাচীর খোলে দেয়া বা ভেদ করতে না পারার কারণে ভবিষ্যতে তাদের কেউ বের হতে পারবে না। কারণ বের হওয়া অসম্ভব ছিলো প্রাচীর বানানো এবং পরে কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু এরপর থেকে তাদের আবির্ভাব হতে থাকবে।’ (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-১৩৩)। 

 

আল্লামা হিফজুর রহমান সিহরাবী তার বিখ্যাত কাসাসুল কোরআন গ্রন্থে এ নিয়ে আরো সুন্দর আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেন, ‘রাসূল (সা.) জেগে ওঠে বলেছেন, ‘ইয়াজূজ-মাজূজের প্রাচীর খোলে দেয়া হয়েছে’ এর দ্বারা যদি উদ্দেশ্য হয় বিভিন্ন ফেতনা ফাসাদ প্রকাশ পাওয়ার রূপক অর্থ তাহলে এর আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে। আর যদি উদ্দেশ্য হয়, বাস্তব অর্থ অর্থাৎ ওই দিনই প্রাচীরের খোলে দেয়া হয়েছে তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ, ওই প্রাচীর কেয়ামতের আগ পর্যন্ত অক্ষত থাকবে এমন কোনো বিষয় নেই। পূর্বে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। অতএব, হতে পারে ওই সময় থেকে প্রাচীরে ফাটল শুরু হয়েছে। অন্যান্য ফেতনা ফাসাদ প্রকাশ হওয়া বা তাদের কোনো কোনো সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ও দুনিয়াতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর আলামত হচ্ছে ওই ফাটল সৃষ্টি হওয়া। রাসূল (সা.) এর ভবিষ্যদ্ববাণী দ্বারা তাতারি ফেতনাও উদ্দেশ্য হতে পারে। ষষ্ট হিজরিতে মুসলিম বিশ্বে যারা পঙ্গপালের মতো ছেয়ে গিয়েছিলো এবং নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো তারাও ইয়াজূজ-মাজূজের অন্তর্ভূক্ত। তবে তারা ইয়াজূজ-মাজূজের শেষ দল নয়। তাদের শেষ দলের আবির্ভাব হবে কেয়ামতের আগে।

 

বর্তমান যুগের কোনো কোনো ঐতিহাসিক রাশিয়া ও চীন অথবা উভয়কে ইয়াজূজ মাজূজের সম্প্রদায় সাব্যস্ত করেছেন। (মাআরেফুল কোরআন বাংলা অনুবাদ, পৃষ্ঠা-৮২৬)। তবে অনেক মুফাসসির, কেয়ামতের আগে আত্মপ্রকাশকারী বর্বর গোষ্ঠীগুলোকে ইয়াজূজ-মাজূজ বলতে অস্বীকার করেছেন। সে হিসেবে বর্তমান চীন ও রাশিয়াকে ইয়াজূজ-মাজূজের সম্প্রদায়ভূক্ত বলা যায় না। বরং তাদের মতে যারা বর্বর গোষ্ঠীগুলো এবং চীন ও রাশিয়াকে ইয়াজূজ-মাজূজ সাব্যস্ত করেছেন ওরা ভ্রান্ত মতের ওপর আছেন। তাদের দলিল হচ্ছে, ইয়াজূজ-মাজূজ কেয়ামতের সময় প্রকাশ হবে। এর আগে হবে না। কিন্তু আমরা আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী ও হিফজুর রহমান সিহরাবীর আলোচনা থেকে বুঝেছি, ইয়াজূজ-মাজূজের মূল সম্প্রদায় কেয়ামতের আগে প্রকাশ পাবে। তবে এর আগেও তাদের থেকে কোনো কোনো সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে। সে আলোকে বলা যায়, বর্তমানের চীন ও রাশিয়ার জাতিগুলো তাদের বংশধর। যেমন হিজরি ষষ্ট শতকের তাতারি সম্প্রদায়ের ব্যাপারে অনেকে মনে করেছেন।

 

ইতিহাসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ইয়াজূজ মাজূজের লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচার জন্য বহু জায়গায় প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিলো। কারণ, তাদের অপতৎপরতার বিস্তৃতি ছিলো বিশাল এলাকাব্যাপী। এক দিকে ককেশিয়ার পাদদেশে বসবাসকারীরা তাদের জুলুম নির্যাতনের শিকার ছিলো। অপর দিকে তিব্বত ও চীনের অধিবাসীরাও ছিলো তাদের আক্রমণের লক্ষ্যস্থল। ইয়াজূজ-মাজূজের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাঝে সর্ববৃহৎ হলো চীনের প্রাচীর। আরেকটি প্রাচীর আছে মধ্য এশিয়ায়। এর অবস্থানস্থলের নাম দরবন্দ। তৃতীয় একটি প্রাচীর রাশিয়ার দাগিস্তানে অবস্থিত। চতুর্থ প্রাচীরটি ককেশিয়ার মালভূমিতে অবস্থিত। এটা দুই পাহাড়ের মধ্যস্থলে অবস্থিত। এই সবগুলো প্রাচীরই উত্তর দিকে। এবং বর্তমান চীন রাশিয়ায়। ইয়াজূজ মাজূজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এসেছে যে, ওরা মানুষের গোশত খেত। বসন্তকালে বের হয়ে আসতো। তখন সব দিকে থাকতো সবুজের সমারোহ। তারা সেগুলোকে খেয়ে সাফ করে ফেলতো। শুকনো খাবারযোগ্য বস্তুগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যেতো। (সফওয়াতুত তাফাসির, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৯৭)। বর্তমান চীনাদের দিকে তাকালেও এর কিছু নমুনা আমরা দেখতে পাই। তারা মানুষের গোশত খায় কিনা জানা নেই। তবে সব প্রাণীর গোশত তারা খেয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে হালাল হারামের হিসেব তারা করে না। অন্যরা খাবার রান্না করে খেয়েও হজম করতে পারে না। তাই চীনাদেরকে ইয়াজূজ-মাজূজের সম্প্রদায়ভূক্ত বলা কোনো অযৌক্তিক নয়-আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন।

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল