• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

আজকের টাঙ্গাইল

আজ ১৭ রমজান: ঐতিহাসিক বদর দিবস

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১১ মে ২০২০  

আজ ১১ মে, ১৭ রমজান।  ইসলামি ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দিন। ঐতিহাসিক বদর দিবস। মিথ্যাকে পরাজিত করে সত্যকে সুউচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠার দিন। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগের ইতিহাস। নবী মুহাম্মদ (সা.) এর নেতৃত্বে হিজরি দ্বিতীয় বর্ষে রমজান মাসের ১৭ তারিখে সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক এ বদর যুদ্ধ।

 

মুসলমানদের ঈমানি শক্তির কাছে কুফরি শক্তির শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে সেদিন বদর প্রান্তরে রচিত হয়েছিল ইসলাম ও মুসলমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় ইতিহাস। এ যুদ্ধের পর থেকে ইসলামের বিজয়ধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র আরবে এবং পতনঘণ্টা বেজে উঠেছিল বিশ্বের দাম্ভিক শক্তি সমূহের। পবিত্র কোরআনে বদরের এ যুদ্ধকে বলা হয়েছে ‘আল ফুরকান’ অর্থাৎ সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী। এ ইতিহাস গৌরবের ও চেতনার। এ ইতিহাস হারানো চেতনা জাগানোর ইতিহাস।

 

ঐতিহাসিকদের মতে হিজরতের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় একটি ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করেন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শান্তি ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে মদিনার অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একটি শান্তি ও সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এদিকে মক্কার কুরাইশরা নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল মদিনায় নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এমনকি মদিনায় আক্রমন করারও তারা পরিকল্পনা করেছিল। এরই অংশ হিসেবে তারা কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানকে সিরিয়ার পাঠিয়েছিল অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্য-রসদ নিয়ে আসার জন্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সংবাদ পেলেন আবু সুফিয়ান সিরিয়া থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্য-রসদের বিশাল সম্ভার নিয়ে মক্কায় ফিরছেন তখন তিনি বদর গিরিপথে আবু সুফিয়ানকে বাধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারন মক্কায় এই অস্ত্র ভাণ্ডার পৌঁছলে কুরাইশরা এই খাদ্য রসদ এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মদিনায় হামলা চালাবে।

 

এ উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসে ৩১৩ জনের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে মদিনা থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর গিরিপথের দিকে রওনা দিলেন। এ দিকে কুরাইশরা আবু সুফিয়ানকে সাহায্য করার জন্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিশাল এক বাহিনী প্রেরণ করলো। সাহাবায়ে কেরামের ক্ষুদ্র বাহিনীর মধ্যে ছিল ৭০ টি উট, ২টি ঘোড়া, আটখানা তরবারি এবং নয়টা লোহার পোশাক। অন‍্য দিকে মক্কা বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল এক হাজার। এর মধ্যে সাত’শ উষ্টারোহী, দু’শ অশ্বারোহী এবং তাদের বাহিনী ছিল পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্য-রসদে সমৃদ্ধ। বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সিপাহসালার ছিলেন স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মক্কা বাহিনীর অধিনায়ক ছিল উৎবা বিন রবিয়া। তাছাড়া মক্কা বাহিনীর সঙ্গে ছিল মক্কার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। যেমন- শায়বা, আবুল বুখতারী, হিশাম, হাকিম, বিন হাজম প্রমুখ।

 

রাসূল (সা.) যখন মক্কা বাহিনীর বিশাল রণ প্রস্তুতির কথা জানতে পারলেন তখন তাদের শক্তি ও প্রাচুর্যের কথা সাহাবায়ে কেরামকে জানিয়ে দিলেন এবং তাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হয়ত আশংকা ছিল যে, সাহাবায়ে কেরামরা এ অসম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে কী না। কারণ সাহাবায়ে কেরাম এক দিকে ছিলেন রিক্ত হস্ত, খাদ্য-রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল অপ্রতুল, শত্রু বাহিনী ছিল নিজেদের থেকে তিনগুনের চেয়ে বেশি। অন‍্য দিকে এ যুদ্ধ ছিল সাহাবায়ে কেরামের নিজেদের গোত্রীয় লোকদের বিরুদ্ধে। এ কারণে রাসূল (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কিন্তু রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যে বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রত্যক্ষ করলেন তাতে তিনি আনন্দিত হয়ে গেলেন। আনসার নেতা সাআদ বিন মাআজ (রা.) নিজেকে দ্বীনের পথে উৎসর্গ করে এক দীর্ঘ জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি এবং আপনার সত‍্যতা স্বীকার করেছি এবং আমরা সাক্ষ‍্য  দিচ্ছি যে, আপনার আনিত দ্বীন সম্পূর্ণ সত্য। হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনি মদিনা থেকে বের হয়েছেন এক ইচ্ছা নিয়ে, কিন্তু আল্লাহ এখন অন‍্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এখন আপনার যা মর্জি হয় করতে পারেন। আমরা সর্বাবস্থায় আপনার সঙ্গে আছি। আপনি আমাদের কে যা ইচ্ছা তা নির্দেশ দেন, আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আপনি আমাদেরকে মহাসমুদ্রের ঝাপ দেয়ার নির্দেশ দিলেও আমরা মহাসমুদ্রে ঝাপ দিতে প্রস্তুত। আমাদের মধ্য থেকে কেউ পেছনে থাকবে না।’ (যুরকানী ১ম খণ্ড)।

 

রাসূল (সা.) সাহাবাদের এরূপ বক্তব্য শুনে খুশি হলেন এবং স্বয়ং আল্লাহ পাকও সাহাবাদের এসব বক্তব্যের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের ফায়সালা করে দিলেন। উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ প্রায় আসন্ন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করলেন, ‘হে পরওয়ারদেগার! তোমার ওয়াদা পূর্ণ কর এই কুরাইশ বাহিনী নিতান্ত অহংকার ও দাম্ভিকতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে, ওরা আপনার বিরোধিতা করছে। হে আল্লাহ! তোমার ওয়াদা পূর্ণ কর, আমাদের বিজয় দান কর’। (সিরাতে ইবনে হিশাম)।

 

রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় হাবীবের দোয়া কবুল করলেন, আল্লাহও তাঁর রাসূলের প্রতি অকুষ্ঠ আনুগত‍্যশীল, শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জ্বীবিত মুসলিম বাহিনীর প্রতি আসমানী সাহায্যের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল। বৃষ্টির মাধ্যমে রাব্বুল আলামিন বদরের বালুকাময় স্থানকে শক্ত করে দিলেন। অন‍্য দিকে মুসলমানরা নিজ নিজ পাত্রে পানি সংরক্ষণ করে নিলেন, ফলে বিরাট সংকট থেকে মুক্তি পেল মুসলিম বাহিনী। ১৭ রমজান যুদ্ধ শুরু হলো। মুসলমানদের আন্তরিকতা ও ঈমানি শক্তির কারণে মহান রাব্বুল আলামিন বদর প্রান্তরে পাঁচ হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে মুসলমানদের সাহায্য করলেন। যুদ্ধের প্রাথমিক বিজয় মুসলমানদের পদচুম্বন করল। কুরাইশের শক্তিশালী তিন নেতা উতবা, শাইবা ও ওয়ালিদ নিহত হলো মুসলিম বাহিনীর আমীর হামজা, আলী, এবং উবায়দা (রা.) এর হাতে। দুই যুবক মাআজ এবং মুআওয়াজের হাতে নিহত হলো বিখ্যাত কুরাইশ নেতা আবু জেহেল। আরেক প্রভাবশালী নেতা উমাইয়া বিন খালফ শোচনীয় ভাবে মৃত্যু বরণ করল তার এক সময়ের কৃতদাস, হজরত বিলাল (রা.) এর হাতে। এভাবে একের পর এক কুরাইশ  বাহিনীর অনেক নেতা মৃত্যু মুখে পতিত হলো এবং মুসলিম বাহিনীর বিজয় কেতন উড্ডীন হলো বদর প্রান্তরে। মুসলমানদের মধ্যে শহিদ হলেন ১৪ জন এবং কাফের বাহিনী মৃত্যু বরণ করলো ৭০ জন এবং বন্দী হলো ৭০ জন। মুসলমানদের ৩১৩ জনের ক্ষুদ্র বাহিনীর হাতে সেদিন পরাজিত হয়েছিল মক্কার এক হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী। অথচ মুসলিম বাহিনীর জনবল, যুদ্ধে উপকরণ ছিল একেবারে সীমিত।

 

আজকের মুসলিম উম্মাহ : সে সময়ের তুলনায় আজ মুসলমানদের শক্তি সামর্থ ও জনসংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু তারপরও সারা বিশ্বে মুসলমানরা ইহুদি, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ ইসলাম বিদ্বেষীদের হাতে মার খাচ্ছে। সারা বিশ্বে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মুসলমানরাই। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, মিয়ানমারের আরাকানের দিকে তাকালে মনে হয় যেন মুসলমানরাই একমাত্র সেই জাতি যাদের জীবন, সম্পদ, ঘরবাড়ি এবং তাদের মা-বোনদের ইজ্জতের কোনো মূল্য নেই। যেভাবে ইচ্ছা কাফের মুশরিকরা মুসলমানদের মারতে পারে, তাদের ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের সম্পদ দখল করতে পারে, তাদের মা-বোনদের ইজ্জত-আবরু যত ইচ্ছা লুন্ঠন করতে পারে। শুধু তাই নয়, আজ পৃথিবীতে যারা সবচেয়ে বেশি মানবাধিকারের কথা বলে তাদের নেতৃত্বেই মুসলিম নিধন চলছে দেশে দেশে।

 

আজ মুসলমান জাতি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত ও নিপীড়িত। নিকট অতীতে ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, মিয়ানমারে যত মুসলমান মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়েছে তা একত্রিত করলে গোটা পৃথিবী কালো মেঘে ডেকে যাবে, যত মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে তাদের হাড়গুলো একত্রিত করলে একটি হিমালয় পর্বতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে, তাদের রক্তগুলো একত্রিত করা হলে ফুরাত নদীর মতো একটি নদী বয়ে যাবে। আজ আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে মুসলমানদের বুকফাঁটা আর্তনাদ। মনে হচ্ছে যেন মুসলমানদের যোগ্য কোনো অভিভাবক নেই, কোনো আশ্রয় দাতা নেই। অথচ এই মুসলমানরাই এক সময় গড়েছিল সভ্যতার সোনালী ইতিহাস-শাসন করেছিল অর্ধ পৃথিবী। ইতিহাসের এই বিজয়ী জাতির আজ এই দুর্দশা কেন? আজ সারা বিশ্বে মুসলমানদের এই চরম দুর্দশার একমাত্র কারণ হলো মুসলমানদের ঈমানি দুর্বলতা এবং কাপুরুষতা। মুসলিম বিশ্ব আজ বহুদাবিভক্ত। মুসলমানরা আজ তাগুতি শক্তির ক্রীড়নক। ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক ও আরাকান, কাশ্মীর, ভারতজুড়ে কাফের মুশরিকরা মুসলিম নিধনের মহড়া দিচ্ছে, ইসরাইলি হায়নারা ফিলিস্তিনের মা-বোনদের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে নৃত্য করে, পিতার সামনে মেয়ের ইজ্জত লুন্ঠন করে, মিয়ানমারের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা মুসলমানদের হত্যা করে অথচ মুসলিম নেতারা এই সব জুলুমের প্রতিবাদটুকুও করতে ভয় পায়। এ অবস্থায় আল্লাহর সাহায্য আসবে কি করে?  বদর প্রান্তরে মুসলমানদের মাঝে যে ঈমানি শক্তি, ঐক্য ও মমত্ববোধ, একনিষ্ঠতা ছিল, সাহাবায়ে কেরামরা যেভাবে ছিলেন কুফুর শিরকের বিরুদ্ধে আপসহীন এসবের কিছুই তো আজ মুসলিম বিশ্বে নেই। আছে শুধু দ্বন্ধ-কলহ, ক্ষমতার লোভ, বিলাসিতা ইত্যাদি। বিশ্বের কোনো একটি দেশেও ইসলামপন্থীদের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য নেই। আর একারণেই আজ মুসলিম বিশ্বের এই অবস্থা।

 

আল্লাহর সাহায্যও মদদ থেকে আমরা বিরত। যদি আমরা বদরের মহান বিজয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি এবং হজরত সাহাবায়ে কেরামদেরর ঈমানি চেতনায় উজ্জীবিত হতে পারি, তাহলে আজও পৃথিবীতে ইসলামের পতাকা উঁচু থাকবে, আমাদের সম্মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে, মুসলমানদের এই দুর্দশা দূর হবে। পৃথিবীর কোনো তাগুতি শক্তি মুসলমানদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ!

আজকের টাঙ্গাইল
আজকের টাঙ্গাইল